সিপন আহমেদ : বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংসদীয় আসন বিন্যাস সবসময়ই আলোচিত বিষয়। কারণ, একটি আসন কমা বা বাড়া শুধু নির্বাচনী মানচিত্রকেই পরিবর্তন করে না, বরং সরাসরি প্রভাব ফেলে কোনো দলের সম্ভাব্য আসনসংখ্যার ওপর। মানিকগঞ্জ জেলা এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
মানিকগঞ্জ বহুদিন ধরেই বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার পর থেকে একাধিক নির্বাচনে দেখা গেছে, জেলার চারটি আসনেই বিএনপি প্রভাবশালী ছিল। আওয়ামী লীগ এ জেলায় কার্যত আসন জিততে পারেনি। সেই কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে যখন আসন পুনর্বিন্যাস হলো, তখনই শুরু হলো বিতর্ক।
সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০০৮) এর আগে নির্বাচন কমিশন সারাদেশে আসন পুনর্বিন্যাস করে। সরকারিভাবে দাবি করা হয়, এটি সম্পূর্ণভাবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে করা হয়েছে। ২০০১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী প্রতিটি সংসদীয় আসনে প্রায় সমান সংখ্যক ভোটার নিশ্চিত করাই ছিল লক্ষ্য।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই পুনর্বিন্যাসে এমন অনেক জেলায় আসন কমানো বা বাড়ানো হয়েছে যেগুলো রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যেসব জেলায় বিএনপির শক্ত ঘাঁটি ছিল, সেখানে আসন কমেছে। আর যেসব জেলায় আওয়ামী লীগ তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী, সেসব জেলায় আসন বাড়ানো হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ:
মানিকগঞ্জ: ৪ আসন থেকে কমে দাঁড়ায় ৩-এ।
মুন্সিগঞ্জ: ৩ আসন থেকে কমে ২-এ।
ঝালকাঠি: ২ আসন থেকে কমে ১-এ।
অন্যদিকে—
ঢাকা: ১৩ আসন থেকে বাড়িয়ে করা হয় ২০।
চট্টগ্রাম: ১৫ আসন থেকে বাড়িয়ে করা হয় ১৬।
গাজীপুর: ৩ আসন থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৪।
এভাবে ঢাকাসহ মহানগরকেন্দ্রিক জেলা ও আওয়ামী লীগ ঘাঁটিগুলোতে আসন বাড়ানো হয়। ফলে ভোটের রাজনীতিতে বিএনপির আসন হারানো এবং আওয়ামী লীগের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়।
মানিকগঞ্জে ২০০৮ সালের আগে ৪টি আসন ছিল। জনসংখ্যা তখন ছিল প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নির্বাচন কমিশন দেখায়, তিন আসনেই ভোটার সংখ্যা সমান ভাগে বসানো সম্ভব। তাই একটি আসন বাদ দেওয়া হয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- মাত্র কয়েক হাজার ভোটারের পার্থক্যের কারণে একটি আসন বাদ দেওয়াটা কতটা যৌক্তিক ছিল? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিএনপির আসন সংখ্যা কমানো। কারণ, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরেই মানিকগঞ্জে আসন জিততে ব্যর্থ হচ্ছিল।
আজকের প্রেক্ষাপটে এ যুক্তি আরও দুর্বল হয়ে গেছে। কারণ, সর্বশেষ ২০২২ সালের আদমশুমারিতে মানিকগঞ্জের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখের বেশি। অর্থাৎ, জনসংখ্যার চাপ অনুযায়ী আবারও চারটি আসন দাবি করার যৌক্তিকতা শতভাগ প্রমাণিত।
আসন বাড়ানো বা কমানোর বিষয়টি শুধু সংখ্যার হিসাব নয়, বরং রাজনৈতিক কৌশলও বটে।
বিএনপি: মানিকগঞ্জে অতীতের মতো আবার চারটি আসন হলে বিএনপি সংগঠিত অবস্থান থেকে লড়াই করার সুযোগ পাবে। ঐতিহাসিকভাবে এ জেলার গ্রামীণ ভোট ব্যাংক বিএনপির শক্ত ঘাঁটি।
আওয়ামী লীগ: একটি আসন বাড়লে দলটির জন্য চ্যালেঞ্জও বাড়বে। তবে আওয়ামী লীগ গত দেড় দশকে স্থানীয় পর্যায়ে সাংগঠনিক বিস্তার ঘটিয়েছে। স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্প ও নতুন প্রজন্মের ভোটারদের টানতে পারলে তারা অন্তত একটি আসনে পাল্টা অবস্থান তৈরি করতে পারে।
জাতীয় রাজনীতি: মানিকগঞ্জের মতো আরও কিছু জেলায় যদি আসন বাড়ে, তবে বিএনপি একটি নতুন গতি পাবে।
আসন বাড়ানো শুধু রাজনৈতিক প্রভাবেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং উন্নয়নের সঙ্গেও সম্পর্কিত। একটি আসন মানে একজন সংসদ সদস্য, যিনি সরাসরি জাতীয় বাজেটে এলাকার স্বার্থ রক্ষা করতে পারেন। মানিকগঞ্জের মতো জেলার অবকাঠামো, শিল্প সম্ভাবনা ও নদীবেষ্টিত ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় এটি অত্যন্ত জরুরি।
এখন প্রশ্ন হলো, নির্বাচন কমিশন কি সত্যিই শুধু জনসংখ্যার অনুপাতে আসন বাড়াবে, নাকি রাজনৈতিক চাপের কাছে নত হবে? সংবিধান অনুযায়ী, প্রতিটি আসনে প্রায় সমানসংখ্যক ভোটার থাকার কথা। বাস্তবে ঢাকার কোনো কোনো আসনে ভোটার সংখ্যা ৭-৮ লাখ ছাড়িয়ে গেছে, আবার অনেক গ্রামীণ আসনে তা ২-৩ লাখে সীমিত। এই বৈষম্য দূর করাই কমিশনের কাজ।
কিন্তু অতীতে দেখা গেছে, এ কাজটি অনেক সময় রাজনৈতিক দলের স্বার্থে ব্যবহার হয়েছে। তাই জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে এবার নির্বাচন কমিশনকে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আসন পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
মানিকগঞ্জবাসীর চারটি আসনের দাবি শুধু রাজনৈতিক আবেগ নয়, এটি বাস্তবসম্মত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এই দাবি পূরণ করাই যৌক্তিক। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আফরোজা খানম রিতা যে দাবি তুলেছেন, সেটি মানিকগঞ্জের জনগণের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর।
নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান, রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ নয়, বরং জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার স্বার্থে মানিকগঞ্জসহ যেসব জেলায় যৌক্তিকভাবে আসন বাড়ার প্রয়োজন, সেখানে তা দ্রুত কার্যকর করা হোক।
কারণ, আসন বাড়া মানে শুধু রাজনৈতিক হিসাব নয়, বরং উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ভিত্তিকে আরও মজবুত করা।
লেখক- সাংবাদিক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।