জুমবাংলা ডেস্ক : ফরিদপুর পাট আবাদের দিক দিয়ে দেশে দ্বিতীয়। জেলার বোয়ালমারীতে ‘সোনালী আঁশ’ খ্যাত পাট বর্তমানে কৃষকের গলার ফাঁস হয়েছে দাঁড়িয়েছে। চলতি মৌসুমে উপজেলায় পাটের ফলন ভালো হলেও পাটের বর্তমান বাজারদর উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে স্থানীয় পাটচাষিদের। পাটের এমন দরপতনে তাদের লাভ তো দূরে থাক্ উৎপাদন খরচই ঠিকমতো উঠছে না। ফলে পাটচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন পাটচাষিরা।
সিরাজগঞ্জে সোনালি পাট চাষ করে সোনালি স্বপ্ন বুনলেও সেই স্বপ্ন যেন অধরাই রয়ে গেছে। জমিতে যতটুকু পাট উৎপাদন হয়েছে সে টুকুরও ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না কৃষক। হাটে তোষা, মেস্তাসহ বিভিন্ন জাতের পাট প্রকার ভেদে প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ১৭শ’ থেকে ২৫শ’ টাকা দরে। উৎপাদন খরচ প্রতি বিঘা জমিতে ১২-১৫ হাজার টাকা। বিঘায় উৎপাদন হয় ৫-৭ মণ পাট।
একই অবস্থা পাবনার চাটমোহরসহ চলনবিল অঞ্চলে। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলায় চলতি মৌসুমে পাটের আবাদ পূর্বের লক্ষ্যমাত্রা ভেদ করলেও উৎপাদিত পাটের মূল্য কম থাকায় হতাশ কৃষক।
সিরাজগঞ্জে পাট চাষি কৃষকের মুখে হাসি নেই। সিরাজগঞ্জে পাট চাষ করে একদিকে যেমন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তেমনই তারাও ব্যবসায় তেমন লাভবান হতে পারছেন না। তাদের দাবি সরকারিভাবে যদি পাট রপ্তানি করা যেত তাহলে সবার জন্যই ভালো হতো। ক্ষতির মুখে পড়তে হতো না কাউকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিরাজগঞ্জের উপ-পরিচালক বাবলু কুমার সূত্রধর বলেন, সিরাজগঞ্জে পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ হাজার ৯১০ হেক্টর। সেখানে অর্জিত হয়েছে ১৭ হাজার ২৯৮ হেক্টর। উপজেলাওয়ারি কাজিপুরে ৫ হাজার ৬৪৫ হেক্টর, সদর উপজেলায় ৩ হাজার ৩৫০ হেক্টর, উল্লাপাড়ায় ১ হাজার ৬২০ হেক্টর, বেলকুচিতে ১ হাজার ৯৬০ হেক্টর, শাহজাদপুরে ৪৩৫ হেক্টর, তাড়াশে ৭৪৫ হেক্টর, রায়গঞ্জে ৮৯২ হেক্টর, চৌহালীতে ৯২০ হেক্টর, কামারখন্দে ১ হাজার ৭৩১ হেক্টর জমিতে পাট চাষাবাদ হয়েছে।
জেলায় মোট ১৭ হাজার ২৯৮ হেক্টর জমি থেকে পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৬ হাজার ২০৯ টন।
সরেজমিনে উল্লাপাড়া হাটে কৃষক ও পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একদিকে যেমন সার, বীজ ও উৎপাদন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জিনিসের দাম বেশি, তেমনই বেড়েছে শ্রমিকের মজুরিও। তাই উৎপাদন খরচ বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ। প্রতি বিঘা জমিতে পাট উৎপাদন করতেই তাদের খরচ হচ্ছে ১২-১৫ হাজার টাকা। আর প্রতি বিঘা জমিতে উৎপাদন হয় ৫-৭ মণ পাট। উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামের মাহেল উদ্দিন প্রামানিকের ছেলে একজন সাধারণ কৃষক আব্দুস সামাদ।
তিনি বলেন, পাট বুনে তো লস। এক বিঘায় খরচ হয় ১০-১৫ হাজার টাকা। পাট হয় ৫-৭ মণ।
পাট বিক্রি করলাম ১৯শ’ টাকা মণ। বিক্রি করে লস হলো, চালানও উঠল না।
তিনি বলেন, তেল, সার ও কীটনাশকের দাম বেশি। উৎপাদন খরচ বেশি কিন্তু বিক্রি করে দাম পাওয়া যায় না। গিয়ে খুব ভোর থেকে হাটের শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, পাট কেনাবেচায় ব্যস্ত কৃষক ও পাইকাররা। হাটে তোষা, মেস্তা ও কেনাফসহ বিভিন্ন জাতের পাটের প্রকার ভেদে প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ১৭শ’ থেকে ২৫শ’ টাকা দরে। উপজেলা ছাড়াও জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে কৃষকরা এসেছেন পাট বিক্রি করতে।
বোয়ালমারীতে হাট-বাজারে পাটের দাম নেই। ফরিদপুরের বোয়ালমারীর কৃষকদের অভিযোগ, গতবছর পাটের ফলন ও দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকরা সোনালি আঁশে সুদিন ফেরার স্বপ্ন বুনছিলেন। কিন্তু চলতি বছরে পাটের দাম মণপ্রতি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কমে যাওয়ায় চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা। তারা বলছেন, চলতি মৌসুমে পাটের যে দাম তাতে পাট বিক্রি করে লাভ তো দূরে থাক্, খরচই উঠছে না। বিশেষ করে বর্গাচাষিদের বিঘাপ্রতি ৫-৭ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।
বোয়ালমারী উপজেলার পাটচাষি কালি কুমার বালা বলেন, এলাকাভেদে একবিঘা জমিতে পাটচাষের জন্য জমি উপযোগী করাসহ খরচ হয়েছে ২৩-২৪ হাজার টাকা।
সেখানে বিঘাপ্রতি তোষা জাতের পাটের উৎপাদন ১০ মণ, আর দেশী পাট উৎপাদন হয় ৯ মণ। সেই হিসেবে ১০ মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ১৮-২০ হাজার টাকায়। পাটকাঠি বিক্রি করা যাচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। সবমিলিয়ে পাটচাষে লাভ থাকছে না।
আরেক পাটচাষি জয়দেব বিশ্বাস বলেন, তিনি গতবছর চার বিঘা জমিতে পাটচাষ করেছিলেন। খরচ বাদ দিয়ে যে পাট হয়েছিল, তাতে তার বিঘাপ্রতি ৪-৫ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। গতবছর প্রতিমণ পাট বিক্রি করেছিলেন ২৬৫০-২৭০০ টাকায়। এবার বিক্রি হচ্ছে ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকায়। খরচ বাদে তার প্রতি বিঘায় লোকসান হচ্ছে কমপক্ষে সাত হাজার টাকা।
সাটুরিয়ায় উৎপাদন খরচই উঠছেনা কৃষকের। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলায় চলতি মৌসুমে পাটের আবাদ পূর্বের লক্ষ্যমাত্রা ভেদ করলেও উৎপাদিত পাটের মূল্য কম থাকায় হতাশ কৃষক। বর্তমান বাজারে ১৭শ’ থেকে ২১শ’ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে পাট। যা পূর্বের তুলনায় এ বছর মণপ্রতি দাম কমেছে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। পাটের বাজারমূল্য এতটাই কম যে, উৎপাদন খরচই উঠছে না বলে দাবি করেছেন কৃষকরা।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সাটুরিয়া উপজেলায় মোট ৫১৫ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। যা গত বছরে চাষ হয়েছিল ৪৫০ হেক্টর জমিতে।
উপজেলার সবচেয়ে বড় পাটের হাট সাটুরিয়া সদর হাট ঘুরে দেখা যায়, প্রান্তিক কৃষকরা রিকশা, ভ্যান, পিকআপ ও নছিমনে করে তাদের উৎপাদিত পাট নিয়ে এসেছেন হাটে। তাদের মধ্যে কেউ বিক্রি করছেন আবার কেউ অপেক্ষায় রয়েছেন ভালো দাম পাওয়ার। কেউ আবার ভালো দাম না পেয়ে পাট ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে।
পাট ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান বলেন, এ বছর পাটের মানভেদে ২১শ’ ও ১৭শ’ টাকা মণ দরে কিনছেন তারা।
তিনি আরও বলেন, মিলে পাটের চাহিদা না থাকার কারণে পাটের দাম অনেক কম।
এ বিষয়ে সাটুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ভরা মৌসুমে যে কোনো ফসলের মূল্যই একটু কম থাকে, পরে সেটার মূল্য বাড়ে।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়াও সঠিক সময়ে পাট কেটে জাগ দিলে আঁশটা গুণগতমানসম্পন্ন হবে। আর গুণগতমানসম্পন্ন আঁশ হলে দামও ভালো পাবে, লাভও ভালো হবে বলে জানান তিনি।
চলনবিল অঞ্চলে পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত চাষিরা। পাবনার চাটমোহরসহ চলনবিল অঞ্চলে পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে চাষিরা বঞ্চিত হচ্ছেন। চাটমোহরসহ চলনবিল এলাকায় চলতি বছরে পাটের ফলন অনেক ভালো হয়েছে। কিন্তু পাট চাষে ব্যয় বেড়েছে। সময়মতো বর্ষার পানি না থাকায় এবারও পাট জাগ দেওয়া নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় এলাকার চাষিদের। এসবের পরও পাট বিক্রি করতে গিয়ে আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। চাটমোহরে পাটের হাট রেলবাজার, শরৎগঞ্জ, ছাইকোলা, মূলগ্রাম, পাচুরিয়া, পৌরসভা নতুন হাট, হান্ডিয়াল হাট ও মির্জাপুরে পাট বেচাকেনা হয়।
এদিকে চলনবিল এলাকার মধ্যে সর্ববৃহৎ হাট তাড়াশ নওগাঁ হাট, চাঁচকৈর হাট ও সলংগা হাট।
সরেজমিনে নওগাঁ ও মির্জাপুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, ভোরের আলো উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অটোভ্যান, করিমন ও নছিমনে চাষিরা পাট নিয়ে হাটে আসছেন। ভালো দামের আশায় বাজারে পাট নিয়ে এলেও দরপতনে হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা। কিছুদিন আগেও হাটে পাটের সর্বোচ্চ দাম ২ হাজার ৬০০ টাকা থাকলেও মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে এদিন ২ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা দরে পাট বেচাকেনা হয়।
চাটমোহর মির্জাপুরের পাট ব্যবসায়ী সাদেক আলী বলেন, সরকার বিদেশ থেকে পাট আমদানি করায় কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।
অনেক পাট ক্রয়কেন্দ্র বন্ধ হওয়াতে আমরা আরও বেশি বিপদে আছি। এসব পাট ক্রয়কেন্দ্র চালু করলে কৃষকরা এবং আমরা স্বস্তি পেতাম।
এই মন্দিরে রয়েছে অদ্ভুত এক পাথর , যা বাজালে ঘণ্টার মতো শব্দ হয়
তিনি আরও বলেন, গত বছর এই সময়ে প্রতি মণ পাট ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এ বছর বর্তমানে সবচেয়ে ভালো পাট আমরা ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকা করে কিনছি। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা না থাকায় এমন হচ্ছে বলে দাবি তার।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।