জুমবাংলা ডেস্ক : ব্যবসায়িক পাওনা ছয় কোটি টাকা। সেই পাওনা না দিয়ে উল্টো পাওনাদারের নামে চাঁদাবাজির মামলা দিলেন দেনাদার। জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের ওই নেতার দায়ের করা মামলার এজাহারে তাকে ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিটি হচ্ছেন এসএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাদেক।
গত ২ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে মোহাম্মদপুরের নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন এসএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাদেক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ‘চাঁদা আদায়ের চেষ্টা’। সঙ্গে ট্যাগ জুড়ে দেওয়া হয়েছে তিনি ‘ডিবি হারুন সিন্ডিকেটের সদস্য’ আর ‘ফ্যাসিস্টদের দোসর’।
তবে, প্রাথমিকভাবে কোনো অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ এবং গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। তিনদিনের মধ্যে ওই ব্যবসায়ীকে জামিন দেন নিম্ন আদালত।
চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি ঢাকার আদালতে জুলফিকার মল্লিক নামের আরেক ব্যবসায়ী মামলাটি দায়ের করেন। মামলার নথি ও বিভিন্ন আলামত নিয়ে যাচাই-বাছাই করে এই প্রতিবেদক। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালে মোট তিনবার জুলফিকার মল্লিককে তুলে নিয়ে ডিবি পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদের মিন্টু রোডের দপ্তরে নেওয়া হয়। সেখানে বিভিন্নভাবে তাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়। পরে এজাহারে চাঁদা দাবির পরিমাণ প্রায় ছয় কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়।
তবে, ডিবি কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, ডিবির মূল গেট দিয়ে প্রবেশের পর অভ্যর্থনা কক্ষে একটি লগখাতা পূরণ করতে হয় প্রত্যেক প্রবেশকারীকে। সেখানে নাম, বাসার ঠিকানা, ফোন নম্বর, কোন অফিসারের কক্ষে যাবেন সেই তথ্য উল্লেখ করতে হয়। কেউ যদি গাড়িতে আসেন, তাকেও গাড়ি থেকে নেমে তথ্যগুলো দিতে হয়। তবে, ২০২৩ সালের ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি ডিবির লগখাতায় জুলফিকার মল্লিক নামে কারও প্রবেশের তথ্য পাওয়া যায়নি।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, আসামি সাদেক ২১ ফেব্রুয়ারি জুলফিকারকে ফোনে হুমকি দিয়ে ডিবি অফিসে যেতে বলেন এবং তিনি সকাল সাড়ে ১১টায় ডিবিতে প্রবেশ করেন। অথচ ডিবি জানায়, ওইদিন লগখাতায় জুলফিকারের প্রবেশের তথ্য পাওয়া যায়নি। শুধু তা-ই নয়, ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ডিবিপ্রধান হারুন নিজ কার্যালয়ে নয় বরং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এক অনুসন্ধান ও মামলা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাগজপত্র যাচাই করে জানা যায়, ব্যবসায়িক পাওনার ছয় কোটি টাকা ফেরত না দেওয়ার কৌশল হিসেবে সাদেকের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছে।
সাদেক জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের লক্ষ্মীপুর জেলার কার্যনির্বাহী কমিটির উপদেষ্টা। এর আগে ওই কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি। কৃষক দলের লক্ষ্মীপুর শাখার বর্তমান সভাপতি তার উপদেষ্টা পদে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, জুলফিকার মল্লিকের কাছে ব্যবসায়িক পাওনা হিসেবে আমি প্রায় ছয় কোটি ৬৪ লাখ টাকা পাই। সেই টাকা না দিয়ে তিনি নানাভাবে গড়িমসি করেন। বর্তমানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর ট্যাগ লাগিয়ে মিথ্যা মামলাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করছেন। জুলফিকারের ভাই যুক্তরাজ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক পারভেজ মল্লিক। ভাইয়ের প্রভাব বিস্তার করার অংশ হিসেবে তিনি আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন। অথচ ডিবি হারুনের সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। এক মামলায় জামিন পাওয়ার পর আমার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন জুলফিকার।
‘সম্পূর্ণ বানোয়াট অভিযোগের ভিত্তিতে আমাকে মামলায় জড়ানো হয়েছে’— উল্লেখ করে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা বরাবর লিখিত আবেদন করেন ভুক্তভোগী আবু সাদেক। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে লিখিত অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমার পাওয়া টাকা তো তিনি দিবেনই না বরং জুলফিকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নতুন করে মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে আমার কাছে দুই কোটি টাকা চাঁদা দাবি করছেন।’
একই অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মহাপরিচালক, মহাপুলিশ পরিদর্শক, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি)সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে জমা দিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের আবেদন করেছেন ভুক্তভোগী।
এ ছাড়া, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছেও যুক্তরাজ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক পারভেজ মল্লিকের বিরুদ্ধে অনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ এনে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানান আবু সাদেক।
নেপথ্যে কী?
সাদেক জানান, ২০১১ সালে জুলফিকার তার অফিসে এসে ব্যবসায়িক সহায়তা চান। একজন আমদানিকারকের কাছে অর্ডার দিয়ে টাকার অভাবে কিছু পণ্য ছাড়াতে পারছেন না বলে জানান। এ অবস্থায় সরল মনে তাকে সহায়তা করা শুরু করেন।
২০১১ সালের ডিসেম্বরে আবু সাদেক প্রথম জুলফিকারকে মালামাল দেন এবং সেই মোতাবেক জুলফিকার নিয়মিত মালামাল নিতে থাকেন। কোম্পানি থেকে বিল পাওয়ার পর আবু সাদেককে পণ্য বিক্রি করে কিস্তিতে টাকা দিতে থাকেন। এভাবে দুজনের মধ্যে নির্ভরযোগ্য সম্পর্ক তৈরি হয়। একপর্যায়ে জুলফিকার তার বাবা-মাকে হজে পাঠানো, ইংল্যান্ডে থাকা বড় ভাই যুক্তরাজ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক পারভেজ মল্লিককে টাকা পাঠানো এবং খুলনায় তার তিন কোটি টাকার বাড়ি নির্মাণের জন্য অনেক টাকা খরচ হয়েছে বলে জানায়। পাশাপাশি পাওনা টাকার কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দেয়। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাদেকের পাওনা গিয়ে দাঁড়ায় ছয় কোটি ৬৩ লাখ ৬২ হাজার ৯৫৬ টাকা।
এরপর জুলফিকার বিভিন্ন তারিখে তিন কোটি ৭১ লাখ টাকার সাতটি চেক সাদেককে দেন। অবশিষ্ট টাকা শিগগিরই ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দেন। তবে, পরবর্তী সময়ে জুলফিকার সাদেকের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ব্যাংকে চিঠি দিয়ে চেকগুলোর নগদানও আটকে দেন। সার্বিক বিষয় উল্লেখ করে ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সাদেক শের-ই-বাংলা নগর থানায় একটি জিডি করেন। ব্যাংকে পাঠানো চিঠি ও জিডির কপি এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
জিডির তদন্ত শুরু হলে জুলফিকার সাদেককে সমঝোতা করার প্রস্তাব দেন। এরপরও সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন জুলফিকার।
সাদেক জানান, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপরই জুলফিকার পাওনা টাকার বিষয়ে আলাপ না করে মামলার ভয়ভীতি দেখান। একপর্যায়ে ভুয়া মামলা দেন। এখনও তিনি নিয়মিত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে, মামলায় সাদেকের বিরুদ্ধে ফ্ল্যাটের দখলদার, গাড়ি ছিনতাইকারী ও হানি ট্র্যাপে ফেলার অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু এসব অভিযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য উল্লেখ নেই মামলার কপিতে।
এসব বিষয়ে জুলফিকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তার বিরুদ্ধে আবু সাদেকের আনা সব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ২০২৩ সালে এসে হিসাব টেনে দেখা যায় তিনি আমাকে সর্বমোট ৮৪ কোটি টাকার মাল দিয়েছেন। কিন্তু আমি টাকা দিয়েছি ৮৯ কোটি ৭৩ লাখ। তখন তার কাছে ৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ফেরত চাইলে তিনি আমাকে হয়রানি শুরু করেন।
তিনি আরও বলেন, সাদেক মামলায় সুবিধা করতে পারবেন না বুঝতে পেরে ডিবি দিয়ে আমাকে অপহরণ করায়। ডিবি অফিসে আমাকে নিয়ে যাওয়ার প্রমাণ আমার কাছে আছে যা আদালতে জমা দেওয়া হবে ।
উল্লেখ্য, ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেকের বিরুদ্ধে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ উল্লেখ করে ভুয়া মামলা দায়ের হয়েছে। এমনও দেখা গেছে, বাদী নিজেও জানেন না যে তিনি মামলার বাদী।
মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে এটির তদারকি করা পুলিশের রমনা বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আদালতের আদেশ থাকায় আসামিকে (সাদেক) গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছিল। তবে, প্রাথমিক তদন্তের পর জেনেছি এজাহারে উল্লিখিত ঘটনাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। আদালতও বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে তাকে জামিন দিয়েছেন। মামলার বাদী ও বিবাদীর মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ও দেনা-পাওনার বিষয় রয়েছে।’
মামলাটি তদন্ত করছেন রমনা থানার এসআই আব্দুল কাদের। তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলে বিস্তারিত বলা যাবে। এ মুহূর্তে বলার মতো কিছু নেই।’
সূত্র : ঢাকা পোস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।