তালহা জুবায়ের : ইলিশ! এক লোভনীয় মাছের নাম। মাছ খায় অথচ ইলিশ পছন্দ করে না, হয়তো এমন বাঙালিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না বিশ্বে। আর তা যদি হয় চাঁদপুরের ইলিশ তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু সুদীর্ঘকাল থেকে চলে আসা ইলিশের জৌলুশ হারাতে বসেছে চাঁদপুর। প্রতিবছর সরকারি হিসেবের খাতায় উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও জেলেরা বলছেন, আগের মতো ইলিশ উঠছে না জালে। দিন দিন ইলিশশূন্য হয়ে পড়ছে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা। ইলিশের চাহিদা আর জোগানের বিপরীত চিত্রে দাম আকাশচূম্বী। জ্বলন্ত উনুনে চড়ানো কড়াইয়ের ফুটন্ত তেলে ভাজা হচ্ছে রূপালি ইলিশ। ভাজা ইলিশের সাথে গরম ভাত, পেঁয়াজ ও শুখনো মরিচ ভাজা। এমন লোভনীয় খাবার উপেক্ষা করে সাধ্য কার!
ভাতের হোটেলের মালিক মো. শাহজাহান। দীর্ঘ ৫০ বছর যাবত ব্যবসায় করছেন চাঁদপুরের বড়স্টেশন মাছঘাট এলাকায়। মাত্র দুই দশক আগেও বড় সাইজের ভাজা ইলিশের ১ টুকরো বিক্রি করতেন ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। এখন তা খেতে গেলে গুনতে হয় ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকা। একই পরিমাণ অর্থে আগে আস্ত একটি ইলিশ মাছ কেনা যেত। অতিরিক্ত দামের কারণে অনেকেই এখন মন ভরে ইলিশ খেতে পারেন না।
হোটেল মালিক মো. শাজাহান বলের, ইলিশ মাছের দাম আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ছোট সাইজের ইলিশের পিস ১০০ টাকায় বিক্রি করি। তবে মাছের দাম বাড়ায় অনেক কাস্টমাররা খেতে এতে দামাদামি করেন।
এক সময়ের রূপালি ইলিশের ভান্ডার চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদী আজ শূন্যের পথে। বছরজুড়ে নদীতে মাছ ধরতে নামা জেলেদের অবস্থা করুণ থেকে আরো করুণ হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পেয়ে। বিভিন্ন এনজিও ও মহাজনদের কাছে করা তাদের ঋণের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
ভাটি অঞ্চলে অতিরিক্ত জাল ফেলা, জাটকা নিধন, দূষণ আর অসংখ্য ডুবচরসহ নানা কারণে ক্রমেই কমে যাচ্ছে নদীর মাছ। এতে করে নদীনির্ভর জেলেদের জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ।
চাঁদপুর সদর উপজেলার চান্দ্রা গ্রামের বাসিন্দা আবুল খায়ের রাঢ়ী। ৬০ উর্ধ্ব এই জেলে সংসারের হাল ধরতে মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার সাথে নদীতে নামেন মাছ শিকারে। প্রায় ৫০ বছরের জেলে জীবনে খুব কাছ থেকে দেখেছেন নদীর চিত্র। এক সময় উজার করে দেওয়া পদ্মা-মেঘনা যেন আজ মৃত প্রায়। বছর বছর কাঙ্ক্ষিত মাছ না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত জেলেরা।
জেলে আবুল খায়ের বলেন, আগে কত মাছ পাওয়া যেত গাঙ্গে। তখন মাছের দাম অনেক কম ছিল। কিন্তু মাছ ভালো পাওয়ায় লাভ হতো। কিন্তু এখন দাম বাড়লেও মাছ না পাওয়ায় জাল বেয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়ে যায়।
আরেক জেলে হোসেন আলী বলেন, কিস্তি আর ঋণের জালে আমরা জর্জরিত। সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়ছে। নদীতে মাছ না থাকায় অনেকেই মাছ ধরা ছেড়ে অন্য কাজে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে।
জেলেদের জালে ইলিশ কম ধরা পড়ার প্রভাব পড়েছে বাজারে। সরকারের খাতায় প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন ঊর্ধ্বমুখী হলেও দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় প্রতি বছর। চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছঘাটে ২০১১ সালেও ১ কেজি ওজনের একটি ইলিশ কেনা যেত ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। একই ওজনের একটি মাছ কিনতে এখন গুনতে হচ্ছে ২০০০ থেকে ২ হাজার ২শ’ টাকা।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য অফিস থেকে পাওয়া তথ্য মতে, চাঁদপুরে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ২০৪১৮ মে. টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২০৪৫১ মে. টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২০৯৩৫ মে. টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৮০১৬.২ মে. টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে : ২৮৪৫০.৫ মে. টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৯১৪০.৭ মে. টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০৯১০ মে. টন, ২০০০-২১ অর্থবছরে ৩৩৯৯২ মে. টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৪০৯২ মে. টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৩৪৩২৬ মে. টন।
চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছ বাজারের জেলেদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ২০১১ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ৭০০-৮০০ টাকা ; ৭শ’-৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ৪৫০-৫০০ টাকা। ২০১২ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ৭৫০-৮০০ টাকা ; ৭শ’-৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ৫০০-৫৫০ টাকা। ২০১৩ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ৮০০-৯০০ টাকা ; ৭শ’-৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ৫৫০-৬৫০টাকা। ২০১৪ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ৮৫০-৯৫০ টাকা ; ৭শ’-৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ৭০০-৭৫০ টাকা। ২০১৫ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ৯০০-১০০০ টাকা ; ৭শ’-৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ৭০০-৮০০টাকা। ২০১৬ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ৯৫০-১০০০ টাকা ; ৭শ’-৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ৭০০-৮০০ টাকা। ২০১৮ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ৯৫০-১০৫০ টাকা ; ৭শ’-৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ৭৫০-৮৫০ টাকা। ২০১৯ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ১০০০-১০৫০ টাকা ; ৭শ’-৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ৭০০-৮৫০ টাকা। ২০২০ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ১০০০-১১০০ টাকা ; ৭শ’-৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ৮০০-৯০০ টাকা। ২০২১ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ১১০০-১২০০ টাকা ; ৭শ’-৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ১০০০-১১০০ টাকা।
২০২২ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ১৩০০-১৩৫০ টাকা ; ৭শ’-৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ১০৫০-১১৫০ টাকা। ২০২৩ সালে ১ কেজি ওজনের ইলিশ ১৪০০-১৫০০ টাকা ; ৭শ’-৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ১১০০-১২০০ টাকা। এবং চলতি ২০২৪ সালে জুন মাস পর্যন্ত ১ কেজি ওজনের ইলিশ ২০০০-২২০০ টাকা ; ৭শ’-৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ১৫০০-১৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু চাঁদপুরে বসবাস করে কেউ যদি বলেন ইলিশ খেতে পায় না, হয়তো অনেকেই অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাবেন তার দিকে। কিন্তু নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের পাত থেকে ইলিশ উঠে গেছে অনেক আগে। বাজারে ইলিশ কিনতে এসে দাম শুনে ভাবনায় পড়েন মধ্যবিত্তরাও। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া অনেকেই এখন আর ইলিশ কিনতে বাজারে আসেন না।
দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই চাঁদপুরে ইলিশ কিনতে এসে দাম শুনে হতাশ হচ্ছেন। এমনকি দিনভর ঘাটে মাছ নিয়ে কাজ করা শ্রমিকরাও খেতে পায় না ইলিশ। কুমিল্লা থেকে মাছ কিনতে আসা মো. ইয়াছিন বলেন, চাঁদপুরে আসি তাজা ইলিশ কিনতে। এখানে মাছ ভালো পাওয়া গেলেও দাম সাধ্যের বাইরে চলে যায়। তাই ৪টার জায়গায় ২টা কিনে নিয়ে যাচ্ছি। এত দাম দিয়ে আমাদের মতো মধ্যম আয়ের মানুষের ইলিশ কিনে খাওয়া অনেক কষ্টের।
স্থানীয় বাসিন্দা বশির হোসেন বলেন, আগে মৌসুমে এত ইলিশ খাওয়া পড়ত, এই মাছ দেখলেও খেতে ইচ্ছা করত না। কিন্তু এখন চাইলেও কিনতে পারি না। সারা বছরই দাম বেশি থাকে।
দেশের অন্যতম বড় ইলিশের পাইকারি বাজার বড় স্টেশন মাছঘাটে একটা সময় মৌসুমে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ হাজার মণ ইলিশ বেঁচা কেনা হতো। কিন্তু বর্তমানে সেই জৌলুশ আর নেই। মাছের সরবরাহ আশঙ্কাজনকভাবে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন আড়ৎদাররা।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল বারী জমাদার বলেন, আগের তুলনায় সকল কিছুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের নৌকার জ্বালানি খরচ বেড়েছে, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। তাই ইলিশ মাছের দামও বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছের আড়ৎ তৈরি হওয়ায় এখন আর আগের মতো মাছ আসে না বাজারে। তাছাড়া নানা কারণে নদীতেও মাছ কম পাওয়া যায়। তাই আমরা যারা ব্যবসায়ী আছি, লাখ লাখ টাকা পুঁজি খাটিয়েও ঠিক মতো ব্যবসায় করতে পারছি না। অনেক ব্যবসায়ী লোকসান গুনছে ব্যবসায় করে।
নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবু কাউছার দিদার বলেন, ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করা হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে প্রতি বছর উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি জাটকা রক্ষা অভিযানেও আমরা গবেষণা করে দেখেছি এ বছর নদীতে প্রচুর জাটকা বেড়ে উঠেছে। আশা করি আগামীতেও উৎপাদনের ধারা অব্যাহত থাকবে।
১৩ বছর পর সিরডাপের গভর্নিং কাউন্সিলের সভাপতি হলো বাংলাদেশ১৩ বছর পর সিরডাপের গভর্নিং কাউন্সিলের সভাপতি হলো বাংলাদেশ
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাঁদপুরেও ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। আগের তুলনায় জেলের সংখ্যা বাড়ায় হয়তো সবাই বেশি মাছ পাচ্ছে না। তাছাড়া ভোক্তার সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। তাই মাছের চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। দাম কিছুটা বেশি হলেও যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা কিনে খেতে পারেন। তাছাড়া ছোট সাইজের মাছ সবার নাগালের মধ্যে রয়েছে।
ইলিশের প্রাচুর্যতা রক্ষায় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ইলিশ নয়, মাছের ফ্লেভারে তুষ্ট থাকতে হবে সাধারণ মানুষকে। সূত্র : দেশ রুপান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।