নাজমুল হক তপন : আড্ডার এক ছোট ভাইয়ের ভাষায়, একবিংশ শতাব্দীতে প্রেমের শোক বড়জোর এক প্যাকেট সিগারেটের আয়ুষ্কালের সমান। প্রেম যদি একটু বেশি গভীর হয়, তবে এক প্যাকেটের বদলে শোকের স্থায়িত্ব এক কার্টন সিগারেটের আয়ুষ্কালের সমান।
Google News গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ”র খবর পড়তে ফলো করুন
প্লেটোনিক লাভের পক্ষের লোকজন এটা মানবে কেন? এরপর আড্ডায় যা হয় আর কি? যুক্তি-পাল্টা যুক্তি।
একজনের ভাষ্য,
‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম
সে এখন ঘোমটাপরা কাজলবধূ দূরের কোনো গাঁয়
পথের মাঝে পথ হারালে আর কি পাওয়া যায়?’
মল্লিকাদির নাম সবাই ভুলে যায় কিন্তু একজন ভোলে না, আর এটাই প্লেটোনিক লাভ।
এটা বেহুদা আবেগ ছাড়া আর কিছুই নয়, জবাব দিল একজন। তার ভাষ্য, প্লেটোনিক লাভ আছে শুধু বংলা সংগীত-সাহিত্যে আর গ্রামার বইয়ে। এ ছাড়া গালভরা এ কথাটির কোনো অস্তিত্বই নেই।
‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না দূরেও ঠেলিয়া দেয়’, এ যুগে বেঁচে থাকলে এমন কথা কি লিখতেন বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র?
দেবদাসের মতোই পারুকে ভুলতে পারেনি দারু। হিসাব না মেলার আর্তি নিয়েই জীবন কাটানো। এসব তো এ যুগে অচল।
খোদ কবিগুরু রবি ঠাকুরই তো লিখেছেন,
ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করি যোগাসন সে নহে আমার।
শরীরকে বাদ দিয়ে ভালোবাসা হয় না, এটাই কি তবে চূড়ান্ত অনুসিদ্ধান্ত?
ইন্দ্রিয়াতীত ভালোবাসার জায়গা মাটির দুনিয়ায় নেই, এটা থাকে শুধু কল্পনাতেই। তার পরও কথা থেকে যায়। কল্পনা সঙ্গে নিয়ে যারা জীবন কাটিয়ে দেন, তাদের অস্বীকার করা যায় কীভাবে?
প্লেটোনিক প্রেম ও আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
ঘটনা-এক
মফস্বল শহরের একজন চিরকুমার কলেজশিক্ষক। রিটায়ার করেছেন। আর ওই শহরেরই গার্লস স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। বলা বাহুল্য, ভদ্রমহিলাও কনফার্মড ব্যাচেলর। দুজনই রাশভারী। গম্ভীর, ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলেন। দুজনকে একসঙ্গে কোনো কমন প্রোগ্রামেও কেউ দেখেনি।
ষাটের দশকে ছাত্ররাজনীতি করতেন। একই সংগঠনে ছিলেন দুজন। একসঙ্গে মিছিল-মিটিংও করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেছে নেন শিক্ষকতা পেশা।
এ পর্যন্ত সবই সরল স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনাটা অন্য জায়গায়।
প্রায় প্রতিদিনই সকালে রাস্তার বাঁ-পাশসংলগ্ন একটা চায়ের দোকানে নির্দিষ্ট সময়ে ওই ভদ্রলোক বসে পত্রিকা পড়েন।
বাসা থেকে ভদ্রমহিলা স্কুলে যেতেন রিকশায়। বেশ খানিকটা দূরত্ব। তার স্কুলে যাওয়ার পথেই পড়ে ওই চায়ের দোকানটা।
বছরের পর বছর চলে আসছে এভাবেই।
ঘটনা-দুই
১৯৯০-এর মাঝামাঝি। তখনও ছাত্রনেতাদের সোসাইটিতে ভীষণ প্রভাব। সহজ করে বললে, নিজের অঞ্চলে হিরোর মর্যাদা তাদের।
এক বড় ভাই। জেলা শহরের সরকারি কলেজ থেকে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই প্যানেলেই ছাত্র মিলনায়তন পদে জিতেছিলেন ওই সংগঠনের এক জুনিয়র কমরেড।
রাতের আড্ডায় বিশেষ করে রাত গভীর হলে ওই মেয়েটার গল্প বলেন বড় ভাই। দুয়েকটি চিঠি দেখান। চিঠিতে প্রেম-ভালোবাসা ছাড়া আর সবই থাকে। সংগঠনের সংবাদ, শহরে সরকারি দলের ক্যাডারদের খবর। কী কী প্রোগ্রাম হচ্ছে এসব আর কি!
বড় ভাইয়ের বিশ্বাস … তার জন্যই মেয়েটা বিয়ে করছে না।
একদিন মেয়েটার বিয়ে ঠিক হলো। বড় ভাই বললেন, যথেষ্ট দেরি হয়েছে, আর না। আজ বাড়ি যাচ্ছি, কাল নাইটকোচে ওকে নিয়ে ঢাকায় আসব। তোমরা সব রেডি রাখবা। ২৪ ঘণ্টার মাইক্রো, একটা সেফ বাসা ইত্যাদি…।
আসার কথা এক দিন পর। অথচ তিন দিন হতে চলল, বড় ভাইয়ের কোনো খোঁজ নেই। পরিস্থিতি বোঝার জন্য ওই শহরে নিজেই উপস্থিত হলাম। গিয়ে দেখি ওই মেয়ের বউভাত অনুষ্ঠান চলছে। আর বড় ভাই ধুমছে কাজ করছেন। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির পরিবারের সঙ্গে বেশ জমিয়ে গল্প করছেন।
আমাকে দেখে একগাল হেসে বললেন, তপন ভালো হয়েছে। অমুক বাবুর্চির রান্না ফার্স্ট ক্লাস। তোমার তো আবার খাওয়াদাওয়া পছন্দ।
উনার কাণ্ড দেখে তো আমার চোখ কপালে!
বউভাত শেষ। রাতের বেলায় নদীর ধারে বড় ভাই ও তার বন্ধুদের সঙ্গে শরিক হলাম আড্ডায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় ভাইয়ের আবেগও বাড়তে থাকল। বিয়ের আগের দিন তাকে নাকি জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছে মেয়েটা। তার পরও বড় ভাই কিছু বলতে পারেননি!
বিয়ের এক দিন আগে তাকে পেয়ে মেয়ের বাবা-মা ভীষণ খুশি। মেয়ের বিয়ের সব কাজকম্ম শেষ না হওয়া পর্যন্ত বড় ভাইকে থাকার জন্য অনুরোধও করেছেন মেয়ের মা-বাবা। তাই কোমর বেঁধে কাজকম্ম করে যাচ্ছেন বড় ভাই।
মেয়ে চলে গেছে শ্বশুরবাড়ি। আমরা মাঝরাতে আড্ডা দিচ্ছি নদীর ধারে। বড় ভাই কখনও চুল ছিঁড়ছেন তো আবার হাত-পা ছুড়ছেন। মুখে বলছেন, আমার কী হবে? বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। ওই শহরের বড় বড় ক্যাডাররা সমঝে চলেন বড় ভাইকে, তার এই অবস্থা!
হালের নগদ প্রেম কিংবা হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে!
দুই বন্ধুর কথোপকথন
প্রথম বন্ধু : মাম্মা ক্রাশ খাইলাম!
দ্বিতীয় বন্ধু : এ নিয়ে কতবার খাইলি?
প্রথম বন্ধু : দোস্ত, চারবার। দোস্ত, বিশ্বাস কর, আগেরগুলা ছিল রং চয়েস।
দ্বিতীয় বন্ধু : দেখ কোন ঘাটে ভিড়িস? আমি তিন নম্বরে আছি। মনে হচ্ছে টিকে যাবে।
তবু ভালোবাসি (বন্ধুত্ব কিংবা বন্ধুবিয়োগ)
ভার্সিটি শুরুর থেকেই দুজন বন্ধু। বলা বাহুল্য, একজন ছেলে আর একজন মেয়ে।
মেয়ের ফিয়াঁসে থাকে দেশের বাইরে। দেশে মেয়েটির বেশিরভাগ সময় কাটে তার বন্ধুর সঙ্গে। ক্লাস-লাইব্রেরি, নাটক-সিনেমা দেখা, ঘোরাঘুরি সবই একসঙ্গে। একদিন ছেলেটা বলে উঠল, তোর জন্য তো আমার কারও সঙ্গে রিলেশন হচ্ছে না। আমাদের সম্পর্ক হতেই পারত।
মেয়েটির জবাব, দোস্ত, হি (বিদেশে থাকা ছেলেটি) ইজ মাই লাভ অ্যান্ড ইউ আর মাই ফ্রেন্ড।
ছেলেটির জবাব, তার মানে যাকে ভালোবাসা যায়, সে কখনও বন্ধু হয় না। আর যে বন্ধু হয়, তাকে ভালোবাসা যায় না!
বিয়ের পর মেয়েটি বিদেশে চলে গেল।
বেশ কিছুদিন পর ভ্যালেন্টাইনস ডেতে ইনবক্সে ছেলেটাকে মেয়েটা লিখল, ‘আমি বন্ধু আর ভালোবাসা দুটোই হারিয়েছি।’
ওই সময় ছেলেটার সঙ্গে ছিল নতুন বান্ধবী।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।