আন্তর্জাতিক ডেস্ক : দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে প্রবাল প্রাচীর ঘেরা এক ল্যাগুন বা উপহ্রদ চাক অ্যাটোল। এর স্বচ্ছ নীল জলে ডুব দিলে আশ্চর্য এক জগতে চলে আসবেন। যেদিকে তাকাবেন বিভিন্ন ধরনের ধ্বংসাবশেষ। যুদ্ধ জাহাজ, সওদাগরি জাহাজ, যুদ্ধ বিমান, সাবমেরিন কী নেই সেখানে! বর্ণিল প্রবাল এগুলোর শরীরে জড়িয়ে আশ্চর্য এক পরিবেশ তৈরি করেছে।
ট্রাক ল্যাগুন বা চাক ল্যাগুন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিল জাপানিজ ইম্পেরিয়াল নেভির একটি বড় ঘাঁটি। বলতে পারেন এটি জাপানিদের জন্য ছিল আমেরিকানদের কাছে পার্ল হারবার যেমন ছিল তেমন। মধ্য ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপ বা অ্যাটোলে ঘাঁটি গাড়া জাপানি সেনাদের জন্য বড় একটি সহায়তার জায়গা ছিল চাক অ্যাটোল বা চাক ল্যাগুন।
ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন। মার্কিন নেভি অপারেশন হেইলস্টোন নামের এক অভিযান পরিচালনা করে চাক ল্যাগুনে। আগেভাগে এমন একটা কিছু ঘটতে পারে টের পেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধবিমান ক্যারিয়ার, যুদ্ধ জাহাজ সরিয়ে নেয়। তবে প্রচুর সংখ্যাক ছোট যুদ্ধ জাহাজ, সওদাগরি জাহাজ, যুদ্ধ বিমান ছিল তখনো জায়গাটিতে। বোমা বর্ষণে ধ্বংস হয় সেগুলো।
দুই দিনের আক্রমণের শেষে দেখা যায় আমেরিকান নেভি ডজন খানিক যুদ্ধ জাহাজ ও ৩২টি সওদাগরি জাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি ধ্বংস হয়েছে আড়াই শ বিমান। এগুলোই দেখতে পাবেন এখন চাক ল্যাগুনের জলে। যতদূর জানা যায় ওই লড়াইয়ে মার্কিন বাহিনীর ৪০ জন নিহত ও ২৫টি প্লেন ধ্বংস হয়, তবে মারা যান কয়েক হাজার জাপানি সেনা।
এখন ট্রাক ল্যাগুনের এই ধ্বংসাবশেষ পরিচিত ‘ট্র্যাক ল্যাগুনের ভুতুড়ে নৌবহর’ নামে। জায়গাটি স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য খুব বিখ্যাত এক জায়গা। ল্যাগুনটি ফেডারেল স্টেটস অব মাইক্রোনেশিয়ার চাক স্টেটের অংশ। ফেডারেল স্টেটস অব মাইক্রোনেশিয়া জায়গাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝতে পেরে এখান থেকে কোনো ধরনের নিদর্শন সরানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আর এতেই যুদ্ধের অসাধারণ সব স্মৃতিচিহ্ন পরিদর্শনের সুযোগ হয়ে যায় ডুবুরিদের।
বিষুব রেখার কাছাকাছি এই জায়গাটির আবহাওয়া শান্ত, তবে গ্রীষ্ম ও শরতে টাইফুন আঘাত হওয়ার ঘটনা ঘটে। মূল দ্বীপগুলোকে ঘিরে রেখেছে প্রবাল প্রাচীর, তাই এখানকার বেশির ভাগ মানুষ মোটামুটি শান্ত জলের এলাকার পাশে থাকে। প্রতিদিনই টুকটাক বৃষ্টি হয়, সেই সঙ্গে আলোর দেখাও পাওয়া যায় নিয়মিত।
চাক ল্যাগুন এখন পুরোনো ধ্বংসাবশেষের খোঁজে সাগর তলে নামের যেসব ডুবুরি তাদের খুব প্রিয় জায়গা। উষ্ণ জল আর স্রোতের তীব্রতা কম থাকায় এখানে জলের তলে নামাটাও কঠিন নয়। ৭৯ বছর ধরে সাগরে তলে থাকলেও যুদ্ধ দিনের সেই স্মৃতিগুলো এখনো চমৎকার অবস্থায় আছে। আর এগুলোর একটি বড় অংশকেই পাওয়া যায় জলের সমতলের ৫০ ফুটের মধ্যে, পরিষ্কার পানিতে। অর্থাৎ বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়াই এ পর্যন্ত নেমে পড়া সম্ভব হয়। তবে আরও বিচিত্র কিছু দেখতে চাইলে আরও গভীরে নামতে হবে।
জাহাজ, যুদ্ধ বিমানের পাশাপাশি এখানে আছে ট্যাংক, বুলডোজার, কামান, টর্পেডোর মতো যুদ্ধে ব্যবহার করা নানা সরঞ্জাম। আর এগুলোকে সময়ের বিবর্তনে অনেকটাই ঢেকে দিয়েছে বর্ণিল সব জলজ উদ্ভিদ। এতে জায়গাটি পরিণত হয়েছে মান্টা রে, সামুদ্রিক কাছিম, হাঙ্গরসহ নানা জলজ প্রাণীর স্বর্গরাজ্যে। নরম প্রবালেরা এখানে আশ্চর্য অলংকরণ তৈরি করেছে নানা অস্ত্র ও জাহাজের মাস্তুলের ওপর। জাহাজগুলোর চারপাশে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে উজ্জ্বল সব রঙের মাছেরা। কখনো কখনো এ রকম কোনো জাহাজের ডেকের বনফুলের মধ্যে আস্তানা গেড়ে বসেছে কোনো ক্লাউন মাছ।
কোনো কোনো জাহাজ এখনো এমন অবস্থায় আছে যে ডুবুরিরা সেটার ইঞ্জিন কক্ষ, ক্রুদের কোয়ার্টার, মালামাল রাখার কামরায় ঢুঁ মারতে পারেন। স্থানীয় ডুবুরি গাইডেরা যারা সাগর তলের এই ধ্বংসাবশেষে নামছেন বহু বছর ধরে তারা অনভিজ্ঞদের সাহায্য করেন সাগর তলে বিচরণে। জাহাজের হুইলহাউস থেকে শুরু করে কম্প্যানিয়ন ওয়ে, বিভিন্ন ডেকে তাঁরা নিয়ে যান অভিযাত্রীদের। চাইলে আপনিও সঙ্গী হতে পারেন এমন একটি দলের। আর সাগর তলের রহস্যময় এক জগতে নিজেকে আবিষ্কার করবেন, চারপাশের অসাধারণ দৃশ্য দেখে রোমাঞ্চে কেঁপে উঠবে আপনার শরীর।
সূত্র: অ্যামিউজিং প্ল্যানেট, এশিয়া প্যাসিফিক বোটিং ডট কম, উইকিপিডিয়া
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।