জুমবাংলা ডেস্ক : আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার কুমড়ো বড়ি। কলাই রুটির মত কুমড়ো বড়ি প্রায় প্রতিটি ঘরেই থাকে এবং রান্না হয়।
মাস কলাইয়ের আটা ও চাল কুমড়ো দিয়ে তৈরি বিশেষ এ খাবার মূলত বন্যা বা অন্য সময় যখন ঘরে অন্য তরকারি থাকে না সেই সময়ের জন্য তৈরি করে রাখা হয়। তবে আপদকালীন সেই খাবার এখন বেশ জনপ্রিয় সবার কাছে, সৃষ্টি হয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। যার কারণে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে কুমড়ো বড়ি। অনলাইন অফলাইন দুই মাধ্যমেই বিক্রিও হচ্ছে, তৈরি হয়েছে উদ্যোক্তা।
জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মাসকলাই ও কুমড়ার বড়ি এপর্যন্ত আমেরিকা,কানাডা, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, ব্রুনাই, জাপান, ভারত সহ প্রায় ১০/ ১২টি দেশে আমার আত্মীয়দের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। দেশের মধ্যে সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লা, রাজশাহী, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, কক্সবাজার সহ অনেক জেলাতে অনলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়েছে।
তারা এ বড়ি খেয়ে আরো নিবে বলে চাহিদা পাঠাচ্ছে। কথা গুলো বললেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়নের মোবারকপুর টিকরী গ্রামের আভিজাত্য পরিবারের মোসফিকুর রহমানের স্ত্রী নুরই জান্নাত বেগম। তিনি আরো জানান, গত একমাসে কেজি প্রতি ৭শ থেকে ৮শ টাকা দরে আমি প্রায় ৪০কেজি বড়ি অনলাইনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে বিক্রি করেছি। খরচ হয় কেজি প্রতি প্রায় ৫শ থেকে ৬ শ টাকা।
সব খরচ বাদে কেজি প্রতি প্রায় ২শ টাকা লাভ হয়। অনলাইনে কেউ অর্ডার দিলে আমরা সেটি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠিয়ে থাকি। আমি এ লাভের টাকা দিয়ে এলাকার গরীব দু:খী ও অসহায় পরিবারের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ায় সহযোগিতা করতে পারি। এমনকি এতিম দু:খীদের মেয়েদের বিয়েতে সহযোগিতা করতে পারি। শুধু তাই নয় আমার প্রয়োজনে সাংসারিক কাজেও খরচ করতে পারি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, করোনা কালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সময় আমার মেয়ে বিএসসি ইঞ্চিনিয়ার আসিফা আফরোজ বাড়িতে এসে পরিবারের সবার সাথে যখন ঘরে বন্দী অবস্থায় অসহায় জীবনযাপন করছিল, তখন সে এলাকার অসহায় গরীব নারীদের কে নিয়ে মাশ কলাই ও কুমড়ার বড়ি তৈরি করে অনলাইনে বিক্রি করার পরিকল্পনা করে। তার দেয়া উৎসাহ ও উদ্দীপণা পেয়েই আশেপাশের কয়েকজন নারীর সাথে পরামর্শ করি।
তারা রাজী হওয়ায় বড়ি দেয়ার কাজ শুরু করি। যা লাভ হয় তার বেশীর ভাগই মহিলা কারিগরদের দেয়ায় তারা আমাদের সাথে কোন চুক্তি করে না। প্রথম বছর আমি ৭০/৮০ হাজার টাকা বড়ি বিক্রি করেছি। এবার চাহিদা অনেক বেশী। তবে সবার চাহিদা পূরণ করতে না পারলেও আমার লক্ষ্য আছে কমপক্ষে ৩/৪লাখ টাকার বড়ি বিক্রি করতে পারবো। এ কাজে আমার খুব ভাল লাগছে। কারন মাশ কলাই ও কুমড়ার বড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রাচীন আমলের কুটির শিল্প। যা সারা দেশেই এর ঐতিহ্য ছড়িয়ে আছে। যা শিবগঞ্জে প্রথম আমিই অনলাইনের মাধ্যমে বিদেশের মাটিতে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছি।
নুরই জান্নাত বেগমের বাড়িতে বড়ির কারিগর একই ইউনিয়নের মোবারকপুর বাগান টুলি গ্রামের আনসার আলির স্ত্রী মনোয়ারা বেগম জানান, কোন চুক্তি ছাড়াই অসহায় নারী বান্ধব এ পরিবারের বাড়িতে ফেব্রƒয়ারি হতে এপ্রিল এ তিন মাসে মাত্র দুই ঘণ্টা বড়ি তৈরি করার কাজ করেই আমরা প্রতিমাসে প্রায় ৩ হাজার টাকা আয় করতে পারি। তাছাড়া তারা অন্যান্য সুযোগসুবিধা দিয়ে থাকেন।
একই গ্রামের হাসান আলির স্ত্রী রুমালী বেগম জানান, বড়ি দিতে যে সমস্ত উপকরণাদির প্রয়োজন হয় তা হলো কুমড়া,মাস কলাই, জাল, কুনি (একধরনের যন্ত্র), খাটলা (এক ধরনের বিছানা যা কাঠ ও দড়ি দিয়ে তৈরি) ৩/৪টি সানকি (এক ধরনের স্টিল বা মাটির বড় পাত্র) ছোট ছোট ২/৩টি বাটি, একটি ছাকনা ও একটি ডালি। একই গ্রামের মেরু ইসলামের স্ত্রী দিপালী বেগম বড়ি দেয়ার নিয়মাবলী সম্পর্কে বলেন, বড়ি দিতে প্রথমে মাস কলাই পানিতে ভিজিয়ে রেখে ডাল তৈরি করতে হয়।
ডাল রোদে শুকিয়ে আটা তৈরি করতে হয়। তারপর একটি কুমড়াকে দুই ভাগ করে কেটে প্রথমে বিচি আলাদা করতে হয়। বিচি বাছাইয়ের পর কুর্নি (এক ধরনের যন্ত্র) দিয়ে কুমড়া কুঁড়ে কুঁড়ে একটি ডালিতে রেখে পরে তা পানিতে ভাল করে ধুয়ে ছাকনায় ছেঁকে কুঁড়া কুমড়া ও আটা ও পরিমান মত পানির সংমিশ্রন করে আটা তৈরি করতে হয়। যা বার বার পরীক্ষা করে দেখতে হয় বড়ি দেয়ার উপযোগী হয়েছে কি না? পরীক্ষার ফলাফল হলো তৈরি করা আটা পানিতে ডুবাতে হবে।
যদি আটা পানিতে ভাসে তাহলে বুঝতে হবে যে বড়ি তৈরির করার উপযোগী হয়েছে। তারপর একটি খাটলাতে জাল বা পাতলা কাপড় বিছিয়ে তার উপর সারিবদ্ধভাবে বড়ি দিতে হয়। যা দেখতেই সুন্দর লাগে। তারপর দুই/তিন দিন রোদে শুকাতে হয়। তিনি আরো জানান, আমাদের এ গ্রামে প্রায় ১০/১২ নারী ন্রুই জান্নাত বেগমের বাড়িতে বড়ি তৈরি কাজ করেই মাসে ৩ হাজার টাকা আয় করতে পারি। যা আমাদের অনেটাই স্বাবলম্বী করে তুলেছে।
এ ব্যাপারে মোবারকপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান হায়দারী বলেন, মোবরকপুর হতে উচ্চশিক্ষিত একজন শিক্ষার্থীর মাধ্যমে অনলাইনে শিবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বড়ির ব্যবসা হচ্ছে যা অত্যন্ত ইতিবাচক।
এ বিষয়ে তৎকালীন শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাকিব আল রাব্বী বলেন, শিবগঞ্জের তৈরি বড়ি আজ বিশ্বের বাজাররে স্থান পেয়েছে যা আনন্দের সংবাদ। আমি এর উত্তরাত্তর উন্নতি কামনা করছি।
শিবগঞ্জ উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শিউলী বেগম বলেন, কুমড়া ও মাসকলাইয়ের বড়ি শতাাধিক বছরের পুরানো চাঁপাইানবাবগঞ্জ জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প। এটি একটি অত্যন্ত সুস্বাদু তরকারী যা বারমাসই ঘরে রাখা যায়। এর সম্প্রসারণের মাধ্যমে অসহায় নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি। উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, শিবগঞ্জে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় সুয়ো ২লাখ ভোটারই নারী।
শুধু শিবগঞ্জ নয় সারা দেশেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের অবদান কোন অংশে কম নয়। শিবগঞ্জে কুটির শিল্পের মাধ্যমে বড়ি সহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও খাদ্য পন্য তৈরি হচ্ছে যাা নারীদের কর্মসংস্থানে বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। এটিকে আরো বেগমান করতে আমরা শিবগঞ্জ উপজেলার মাসিক উন্নয়ন সভায় আলোচনা করার মাধ্যমে ক্ষুদ্র লোন দিয়ে কুটির শিল্পের বিশেষ করে বড়ির ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটনো হবে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দিল আহম্মেদ শিমুল বলেন, শিবগঞ্জের বড়ির যে স্বাদ তা দেশের আর কোথাও নেই। আমার এলাকার মাসকলাই ও কুমড়ার বড়ি আজ দেশের ও দেশের বাইরে সরবরাহ হচ্ছে। যা কুটির শিল্পের মাধ্যমে নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে অত্যন্ত ইতিবাচক। খুব শিগগিরই উপজেলার প্রত্যান্তাঞ্চলে বড়ি নামক কুটির শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে অসহায় মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।