লাইফস্টাইল ডেস্ক : চিংড়ির মালাইকারি! উফফফফফ। ভাবলেই কেমন যেন…। চিংড়িতে যাদের অ্যালার্জি নেই, এই পদের নাম শুনলেই তাদের জিব লক লক করে উঠতে বাধ্য। কিন্তু নাম কেন মালাইকারি? গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, মালয় মুলুক বা মালয়েশিয়া থেকে এই পদের আমদানি হয়েছে বলে এর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মালাই শব্দটি। আবার অন্য অনেকে মালাইকারির অবিচ্ছেদ্য উপকরণ নারকেলের দুধের মধ্যে মালাই শব্দটির উৎস খুঁজে পান। এ সব কথা অজানা নয়। কিন্তু ‘কারি’ এল কোথা থেকে? রান্নাটা ঝোল ঝোল, সেই জন্যই কি কারি? উঁহু, ব্যাপারটা এত সোজা হলে তো হয়েই যেত। মালাইকারির কারি শব্দটা নাকি এসেছে কারি পাতা থেকে। সে দিক থেকে মালাইকারিতে কারি পাতা না-দিলে সেটা মালাইকারিই নয়। খোদ লীলা মজুমদারই মালাইকারিতে কারিপাতা দেওয়ার কথা বলেছেন। তা হলে? ভাবো ভাবো বাঙালি, ভাবা প্র্যাক্টিস করো। আবার কোনও কোনও রেসিপি-তে চিংড়ির মালাইকারিতে এক খণ্ড লাউ দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। বলছেন ঠাকুরপরিবারের কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী স্বয়ং। মানেটা কী?
চিংড়িকে কেউ কেউ মাছ বলেন, আবার অনেকে চিংড়িকে মাছ বলতে নারাজ। তাঁরা বলেন, চিংড়ি হলো জলের পোকা। তাঁদের প্রশ্ন, কাঁকড়াকে কি আপনি মাছ বলতে পারেন? টেকনিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তিটা মন্দ নয়। যে কারণে রেস্তোরাঁ বা ইটারির একাংশের মেনু-তে ফিশ বা মাছের পদের মধ্যে চিংড়ি বিভিন্ন পদকে না-রেখে সেগুলোকে সরানো হয়েছে সি-ফুডের আওতায়। কিন্তু মাছের মতোই খুব বেশি চিংড়ি খাওয়া হয় বলে চলতি কথায় আমরা, বাঙালিরা অনেকেই চিংড়িকে মাছ বলে গণ্য করি। চিংড়ি মাছ হোক বা না-হোক, চিংড়ির সব চেয়ে জনপ্রিয় পদ হল চিংড়ির মালাইকারি এবং তার ওই রান্নার মূল উপকরণ হল নারকেলের দুধ।
ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, তামিলনাড়ুর চেট্টিনাড় বা চেট্টিনাড়ু অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অর্থাৎ চেট্টিয়াররা তাঁদের ব্যবসার কাজে মালয় মুলুকে পাড়ি দিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে ওই রান্না শিখে এসেছিলেন। তামিলনাড়ু রাজ্যে এখন যেটা শিবগঙ্গা জেলা, সেখানেই মূলত অবস্থিত ওই চেট্টিনাড় বা চেট্টিনাড়ু অঞ্চল। তামিলনাড়ুর বহু মানুষ নিরামিষাশী হলেও চেট্টিয়ারদের একটা বড় অংশ কিন্তু আমিষই খান। তা ছাড়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় যেমন নারকেল গাছ পর্যাপ্ত পরিমাণে, তেমনই তামিলনাড়ুতেও প্রচুর নারকেল গাছ। কাজেই মালয় দেশের ওই রান্নাকে নিজের করে নিতে তামিলদের, বিশেষ করে চেট্টিয়ারদের একেবারেই সমস্যা হলো না।
কিন্তু চিংড়ির মালয় কারিকে কি বাঙালিরা আত্মস্থ করে নেওয়ার পরই তার নাম হল মালাইকারি? ভাষাতাত্ত্বিক বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের মতে, ‘মালাই শব্দ আসলে ফারসি বালাহ থেকে এসেছে, যার অর্থ ঘন দুধ, ক্ষীর বা সর…কিন্তু চিংড়ির মালাইকারিতে মালাই তো থাকে না, থাকে নারকোলের দুধ…।’ পান-ভোজনের অনন্ত রসিক ও জ্ঞানের ভাণ্ডারী রাধাপ্রসাদ গুপ্ত বা আরপি ওরফে শাঁটুলবাবু মনে করে, মালাই নামটা উর্দুভাষি বাবুর্চি মহল থেকে এসেছে। রাধাপ্রসাদ গুপ্তই অস্ট্রেলিয়ান লেখিকা রোজমেরি ব্রিসেনডেনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, যিনি তাঁর ‘সাউথ ইস্ট এশিয়ান ফুড’-এ বলেছেন ফ্রায়েড প্রন কারির কথা। সেই কারি হুবহু আমাদের মালাইকারি। তবে তার উপকরণের মধ্যে রয়েছে কারি পাতাও। লীলা মজুমদারও জানিয়েছেন, মালাইকারি রান্নায় ইচ্ছে হলে কারিপাতা দেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে কারি মানে কেবলই কারি বা ঝোল নয়, কারি পাতাও।
ঠাকুরবাড়ির কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী চিংড়ি মালাইকারির যে রেসিপি দিয়েছেন, তাতে এক ফালি লাউয়ের উল্লেখ রয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, কড়াইয়ে ঘি গরম করে তাতে গরমশলা, আদা-রসুন-পেঁয়াজ দিয়ে মশলা লাল হওয়ার পর তাতে লাউ ও চিংড়ি একসঙ্গে ছাড়তে হবে। লাউ দেওয়া হচ্ছে, কী কারণে, তার ব্যাখ্যা অবশ্য তিনি দেননি। একেবারে শেষে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী বলেছেন, ‘শসা, ছাঁচিকুমড়া, আলু দিয়াও ইহা করিতে পারা যায়।’
কলেজ স্ট্রিট লাগোয়া ভবানী দত্ত লেনের স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলে চিংড়ির মালাইকারিতে আলু দেওয়া হয়। তা বলে মালাইকারিতে শসা, কুমড়ো, লাউ?
কত কিছুই যে আমাদের অজানা!
সে যা-ই হোক, মালাইকারি হবে কোন চিংড়ি দিয়ে? বাগদা নাকি গলদা? এই ব্যাপারে লড়াই কিন্তু প্রবল। এটাও অনেকটা ঘটি-বাঙালের লড়াই। কী ভাবে?
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।