মুফতি আবদুল্লাহ তামিম : দেশের এমন মসজিদ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখানে চেয়ারে বসে নামাজ আদায়কারী নেই। অথচ আজ থেকে পাঁচ দশ বছর আগে মসজিদ এমন ছিলোই না বললে চলে। দিন দিন এর সংখ্যা বেড়েই চলছে। মূলত মাসআলা কী? এ বিষয়ে আজ জানবো।
সাত ধরণের মানুষ আছে, যারা চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করলে নামাজই হবে না। এজন্য চেয়ারে বসে নামাজ আদায়ের বিষয়ে জানা খুবই জরুরি।
১. যে ব্যক্তি শরিয়তের দৃষ্টিতে মাজুর নয়, অর্থাৎ কিয়াম, রুকু-সিজদা করতে সক্ষম, তার জন্য যমিনে বা চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করাই জায়েজ নয়। অথচ কখনো কখনো দেখা যায়, এ ধরনের সুস্থ ব্যক্তিও সামনে চেয়ার পেয়ে চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করে নেয়। ফলে তার নামাজই হয় না।
২. শুধু আরামের জন্য অথবা মামুলি কষ্টের বাহানায় চেয়ারে বসে নামাজ পড়লে নামাজ আদায় হবে না। এমনকি যমিনে বসে পড়লেও আদায় হবে না।
৩. যার পায়ে বা কোমরে ব্যথা। দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক নিয়মে রুকু-সিজদা করে নামাজ পড়লে শরীরে ব্যথা লাগে। কিন্তু তার ব্যথা এ পরিমাণের নয় যে, তা অনেক বেশি। যা সহ্যের বাইরে; বরং এ ব্যথা নিয়ে সে কিয়াম ও রুকু-সিজদা করে নামাজ পড়তে পারে তবে তার জন্যও যমিনে বা চেয়ারে বসে নামাজ পড়ার কোনো সুযোগ নেই। এমন করলে নামাজ আদায় হবে না।
৪. যে কিছুটা অসুস্থ। কিন্তু তার অসুস্থতা এ পর্যায়ের নয় যে, সে কিয়াম ও রুকু-সিজদা করে নামাজ পড়তে সক্ষমই নয়, বা এভাবে নামাজ পড়লে তার রোগ বেড়ে যাবে কিংবা রোগ নিরাময় হতে বিলম্ব হবেÑ এমনও নয়। এমন অল্প অসুস্থতার অজুহাতে যমিনে বা চেয়ারে বসে নামাজ পড়লে নামাজ আদায় হবে না।
৫. যে ব্যক্তি নামাজে কিয়াম তথা দাঁড়াতে সক্ষম। যমিনে সিজদাও করতে পারে। কিন্তু পা ভাঁজ করে তাশাহহুদের সুরতে বসতে পারে না। তবে পা ছড়িয়ে বা চারজানু হয়ে বা এক পা বিছিয়ে আরেক পা উঠিয়ে কিংবা এক পায়ের পাতা বিছিয়ে আরেক পা বের করে অথবা উভয় পা বের করে বা অন্য যে কোনো পদ্ধতিতে যমিনে বসতে পারে এবং যমিনে সিজদাও করতে পারে তার জন্যও চেয়ারে বসে নামাজ পড়া জায়েজ নয়। সে যেভাবে সম্ভব বসেই যমিনে সিজদা করে নামাজ আদায় করবে এবং কিয়াম ও রুকুও যথানিয়মে আদায় করবে।
পুরোপুরি সুন্নত তরিকায় তাশাহহুদের সুরতে বসতে না পারার অজুহাতে তার জন্য চেয়ারে বসে নামাজ পড়ার কোনো সুযোগ নেই। এমন ব্যক্তি যমিনে সিজদা না করে চেয়ারে বসে ইশারায় সিজদা করলে তার নামাজ সহীহ হবে না।
৬. যে ব্যক্তি নামাজে কিয়াম তথা দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে সক্ষম নয়, কিন্তু যমিনে বা সমতলে কোনো না কোনো পদ্ধতিতে বসতে পারে এবং যমিনে সিজদাও করতে পারে, তবে চেয়ারে বসে নামাজ শুরু করলে সিজদা ও কা‘দা (বৈঠক)-এর জন্য যমিনে নামতে সক্ষম নয় তার জন্যও চেয়ারে বসে নামাজ পড়া জায়েজ নয়। এমন ব্যক্তি যেহেতু সমতলে বসে সিজদার ফরয আদায় করতে সক্ষম তাই শুরু থেকেই সে যমিনে বা সমতলে বসে যথানিয়মে সিজদা করে নামাজ আদায় করবে; নতুবা তার নামাজ আদায় হবে না।
৭. যে ব্যক্তি নামাজে কিয়াম তথা দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে সক্ষম, আবার জমিনে বা সমতলে বসতেও পারে এবং যমিনে সিজদাও করতে পারে, কিন্তু নামাজে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসতে পারে না, তেমনি বসলে আবার দাঁড়াতে পারে না তার জন্যও চেয়ারে বসে পড়া জায়েজ নয়। বরং সে পুরো নামাজ নিচে বসে আদায় করবে, যাতে যথানিয়মে যমিনে সিজদা করতে পারে; নতুবা তার নামাজ সহিহ হবে না।
যারা পুরো নামাজ চেয়ারে বসে পড়তে পারবেন
যে ব্যক্তি নামাজের কিয়াম, রুকু-সিজদা ও কা‘দা (তাশাহহুদের জন্য বসা) কোনোটিই স্বাভাবিকভাবে আদায় করতে সক্ষম নয়; বরং শুধু চেয়ারেই বসতে পারে কেবল এমন অসুস্থ ব্যক্তির জন্য পুরো নামাজ চেয়ারে বসে আদায় করা জায়েজ।
কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, এই ব্যক্তি যে কিয়াম, রুকু-সিজদা ও কা‘দা (বৈঠক) সবগুলোই যথানিয়মে স্বাভাবিকভাবে আদায় করতে সক্ষম নয় তা বাস্তবসম্মত ও সুপ্রমাণিত হতে হবে। এর জন্য ডাক্তারের পরামর্শের পাশাপাশি কোনো মুফতি সাহেবকে নিজের অবস্থা পুরোপুরি জানিয়ে তার থেকে মাসআলা নিয়ে সে অনুযায়ী আমল করবে। নতুবা নিজে নিজে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে কখনো নামাজ নাও হতে পারে।
মোদ্দাকথা এই যে, যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পদ্ধতি হল, যমিনে বসে তা আদায় করা। আর যে রুকু-সিজদা করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পন্থা হল, ইশারায় রুকু-সিজদা আদায় করা। আর যে ব্যক্তি জমিনে বসতে অক্ষম তার জন্য জমিনে বসে কা‘দা আদায়ের বিকল্প হল চেয়ারে বসা। কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় ওযরের কারণে চেয়ারে বসা জায়েজ নয়।
নবীজির জামানায় কি চেয়ার ছিলো?
অধিকাংশ ক্ষেত্রে চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করা একেবারেই নাজায়েজ। এসব ক্ষেত্রে নামাজই শুদ্ধ হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নামাজের আংশিক চেয়ারে বসে আদায় করলে যদিও নামাজ ফাসেদ হয় না, কিন্তু তা মাকরূহ। কেবল একটি ক্ষেত্র এমন, যেখানে চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করলে নামাজ আদায়ও হয়ে যায় এবং মাকরূহও হয় না।
এই বাস্তবতাটি যদি আমরা যথাযথ উপলব্ধি করতে পারি তাহলে এ বিষয়টি বুঝতে আমাদের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয় যে, বর্তমানে মসজিদগুলোতে চেয়ারের যে ভিড় পরিলক্ষিত হচ্ছে, দিন দিন যা বেড়েই চলেছে, এটা কেবল এজন্যই যে, মাসআলা জানা না থাকার কারণে এমন অনেক মুসল্লিও নামাজে চেয়ার ব্যবহার করে থাকেন, যাদের জন্য নামাজে চেয়ার ব্যবহার জায়েজই নয়।
মুসল্লিরা যদি হিম্মত করে শরয়ি ওজর ব্যতীত নামাজে চেয়ার ব্যবহার পরিত্যাগ করেন, নামাজে চেয়ার ব্যবহারকে শরয়ি রুখসত (শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত ছাড়) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখেন তাহলে মসজিদগুলোতে চেয়ারের এই ভিড় হ্রাস পাবে। অধিকাংশ মসজিদে চেয়ারের কোনো প্রয়োজনও পড়বে না।
আর এমনটিই হওয়া চাই, কেননা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামানায়ও চেয়ারের অস্তিত্ব ছিল; বরং এরও বহু পূর্ব থেকে ছিল। আর প্রথম থেকেই মাযূর ও অসুস্থ মুসল্লি ছিলেন।
কিন্তু ইতিহাসে এমন কোনো নজির পাওয়া যায় না যে, মসজিদগুলোতে চেয়ার পাতা থাকত। অথবা মাজুর মুসল্লিগণ চেয়ার নিয়ে এসে তাতে নামাজ আদায় করতেন। মসজিদে চেয়ার পেতে রাখা ও চেয়ারে নামাজ আদায় করার যে প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে তা সম্পূর্ণ নতুন রেওয়াজ। এটাকে নিরুৎসাহিত করাই কাম্য। আর অনুসৃত পন্থার প্রতি মনোনিবেশ করার মাঝেই রয়েছে কল্যাণ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।