জ্ঞানের মূল উৎস ‘ওহি’ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর ‘সুন্নাহ’। ‘আইয়ামে জাহিলিয়াতে’ শিক্ষিত ছিলেন মাত্র সতেরোজন। মানবতা নিমজ্জিত হয় নিকষকালো অন্ধকারে। ওই সমাজেই প্রিয় নবী (সা.) পরিচয় দিলেন, ‘বু-ইসতু মুআল্লিমান অর্থাৎ আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে’ (ইবনে মাজাহ)।
শোনালেন মহান আল্লাহর প্রথম নির্দেশনা ‘পাঠ করো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন… তিনি মানুষকে তাই শিখিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ০১-০৫)
পবিত্র কোরআনের আলোকে জ্ঞানের কয়েকটি প্রকারভেদ আছে। যেমন—‘ইলমুল ইয়াকিন’ বা বিশ্বাসগত জ্ঞান, ‘আইনুল ইয়াকিন’ বা চাক্ষুষজ্ঞান, ‘হাক্কুল ইয়াকিন’ বা সত্যজ্ঞান। জ্ঞানার্জন ফরজ।
প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘দ্বিনি জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।’ প্রিয় নবী (সা.) দারুল আরকাম প্রতিষ্ঠা, গোত্রে গোত্রে শিক্ষিত সাহাবিদের প্রেরণ, আসহাবে সুফফার নিয়মিত শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ, যুদ্ধবন্দিদের মুক্তিপণ হিসেবে শিক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
আজওয়াজে মুতাহহারা, আহলে বাইত, সাহাবা কিরাম, তাবেঈ-তাবেতাবেঈন এবং তাফসির, হাদিস, ফিকহ, তাসাউফের ইমাম, মুজতাদি, আউলিয়াগণ একেকজন ছিলেন উচ্চ নৈতিকতা ও শ্রেষ্ঠত্বের দ্যুতিবাহক শিক্ষক।
পবিত্র কোরআনের ৭৫৬টি আয়াতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ থাকায় অবাক বিস্ময়ে মুসলিম মহামনীষীগণের সমর্পণ : ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি ’ (সুরা : আল ইমরান, আয়াত : ১৯১)
প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘জ্ঞানের কথা জ্ঞানীর হারানো মহামূল্যবান ধন, তা সে যেখানেই পাবে, তা গ্রহণ করার অধিকার আছে তার।’ (ইবনু মাজাহ)
তা-ই মুসলিম মনীষীগণের অবদান অনস্বীকার্য :
জাবির ইবনু হাইয়্যান—রসায়নশাস্ত্রের পথিকৃৎ।
আল-বিরুনি—বিশ্বসেরা ভূগোলবিশারদ।
ইবনু সিনা—চিকিৎসাশাস্ত্রের পথিকৃৎ।
আল ফারাবি—পদার্থবিজ্ঞানের নানা সূত্র আবিষ্কারক।
ওমর খৈয়াম—অ্যানালিটিক জ্যামিতির পথিকৃৎ।
আল কিন্দি—সাংকেতিক বার্তার পাঠোদ্ধারকারী।
আল খাওয়ারিজমি—বীজগণিতের পথিকৃৎ।
আল রাজি—গুটিবসন্তের টিকার আবিষ্কারক।
আর্থিক মূল্যমানে শিক্ষকতাকে পরিমাপ করা বাতুলতা। তবে কোরআনের কিছু আয়াত ও মহানবী (সা.)-এর কিছু হাদিস দ্বারা তার কিছু ধারণা পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই জ্ঞানীগণই আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে।’ (সুরা : ফাতির, আয়াত : ২৮)
বোঝা গেল, প্রকৃত জ্ঞান সেটাই যেটা মানুষকে মুত্তাকি করে তোলে।
তিনি বলেন, ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে’? (সুরা : জুমার, আয়াত : ০৯)। এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, মহান আল্লাহ জ্ঞান দ্বারা মানুষকে বিশেষ সম্মান দান করেন। শিক্ষকরাও সেই জ্ঞান বিতরণকারী হিসেবে সেই বিশেষ সম্মানের অধিকারী।
তিনি আরো বলেন, ‘যাকে জ্ঞান দান করা হয়েছে তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়েছে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৬৯)
সে হিসেবে বলা যায়, মহান আল্লাহ যাদের সঠিক জ্ঞান বিতরণের যোগ্যতা ও তাওফিক দিয়েছেন, সেও মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ কল্যাণপ্রাপ্ত।
প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘নৈতিকতার বিচারে যে লোক উত্তম মুমিনদের মধ্যে সেই পূর্ণ ঈমানের অধিকারী।’ (তিরমিজি)। প্রিয় নবী (সা.) আরো বলেন, ‘কল্যাণকর বিদ্যাদানকারীর জন্য (প্রাণ, প্রকৃতির) সবাই আল্লাহর কাছে মাগফিরাত কামনা করে।’ (তিরমিজি)
সুবহানাল্লাহ, এই হাদিস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে যারা কল্যাণকর বিদ্যা শিক্ষা দেয়, তারা কত সৌভাগ্যবান! এ ব্যাপারে প্রিয় নবী (সা.) আরো বলেন, ‘সর্বোত্তম দান হলো কোনো মুসলমান নিজে কোনো বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে পরে তা অপর মুসলমানকে শিক্ষা দেয়।’ (ইবনে মাজাহ)।
তিনিই (সা.) বলেন, ‘শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই সওয়াবের অধিকারী।’ (ইবনে মাজাহ)। অর্থাৎ কল্যাণকর দ্বিনি ইলমের শিক্ষকরা শুধু দুনিয়াতেই সম্মানিত নয়, এর দ্বারা তাদের পরকালও সুসজ্জিত হয়। তবে জ্ঞান তখনই কল্যাণকর হবে, যখন জ্ঞানী তার জ্ঞান মোতাবেক আমল করবে। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘প্রকৃত জ্ঞানী সে, যে নিজে যা জানে সে অনুযায়ী আমল করে…।’
ইদানীং তথাকথিত স্বশিক্ষা, অপশিক্ষা, অর্ধশিক্ষায় শিক্ষিতজনের কারণে বিতর্ক-বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে! মূল্যায়িত হচ্ছেন না প্রকৃত শিক্ষক। প্রিয় নবীর (সা.) সতর্কবার্তা ‘…যখন একজন সত্যপন্থী আলেমও থাকবে না, তখন লোকেরা মূর্খদের তাদের নেতা বানাবে। এ মূর্খরা ধর্মীয় বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে অজ্ঞতা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত দেবে। ফলে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে, অন্যদেরও পথভ্রষ্ট করবে।’ (বুখারি)
৫ অক্টোবর সারা বিশ্বে ১৯৯৪ সাল থেকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হয়। এবার ইউনেসকোর প্রতিপাদ্য : Recasting teaching as a collaborative profession (শিক্ষকতাকে একটি সহযোগী পেশা হিসেবে পুনর্গঠন)। ছন্দরূপ—
শিক্ষকতায় সহযোগী বন্ধন, নব শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন প্রয়োজন। জাতিকে খাড়া রাখার শক্তি জোগায় যাঁরা তাঁরাই ‘মানুষ গড়ার কারিগর’। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ অধ্যাপক গোলাম রাব্বানির আবেগঘন আবৃত্তি এবং অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌসের বক্তব্য ছিল বুলেটের চেয়ে তির্যক—‘একটা মারবেন ১০টা আসব, ১০টা মারবেন লাখো আসব…’ ‘মনে হয় রাস্তায় শহীদ হয়ে গেলে যদি এই লজ্জা আমার কিছুটা কাটে…!’
বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৫ সফল হোক। শিক্ষকের সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।
লেখক : মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।