জুমবাংলা ডেস্ক : রাজশাহী চিনিকলে এক কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ৪০৫ টাকা ৬৮ পয়সা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি মাত্র ১০০ টাকায়। এছাড়া আখ চাষে কৃষককে ভর্তুকি দেয়া, আখ সংকট, জমিস্বল্পতা, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানামুখী সংকটে পড়েছে চিনিকলটি। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ৩২ কোটি ১২ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষ জানায়।
চিনিকলসংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২০ সালে ১৫টির মধ্যে পাবনা, কুষ্টিয়া, রংপুর, পঞ্চগড়, শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকলে আখ মাড়াই বন্ধ করে পাশের চিনিকলগুলোয় মাড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ওই সময় রাজশাহী চিনিকলও বন্ধ হয়ে যাবে বলে গুঞ্জন উঠেছিল। এ কারণে মিল থেকে চাষীদের সরবরাহের জন্য সার, বীজ, কীটনাশকসহ অন্য কৃষিজাত উপকরণ অন্য চিনিকলে পাঠানো হয়। এতে স্থানীয় আখচাষীরা হতাশ হয়ে মুড়ি আখ তুলে ফেলেন। অধিকাংশ কৃষকই তাদের জমিতে আখের বদলে অন্যান্য ফসল চাষ শুরু করেন। আবার অনেকেই চাষযোগ্য জমি কেটে পুকুর খনন করেন। এতে বিরূপ প্রভাব পড়ে রাজশাহী চিনিকলের ওপর। আখ সংকটের কারণে গত তিন বছরে চিনি উৎপাদন কমে আসে তিন-চতুর্থাংশ। কিন্তু তৎকালে রাজশাহী চিনিকল উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকায় বন্ধের তালিকা থেকে বাদ যায়।
চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ মৌসুমে মাড়াই হয়েছে ৯৩ হাজার ৯৪ টন। এতে চিনি উৎপাদন হয়েছে ৫ হাজার ৪৪৮ টন। ২০১৮-১৯ মৌসুমে আখ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ সময় আখ মাড়াই হয় ১ লাখ ২ হাজার ৫২৫ টন। তা থেকে উৎপাদন হয় ৬ হাজার ২১২ টন চিনি। ২০১৯-২০ মৌসুমে আখ মাড়াই হয় ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫২ টন, যা আগের তুলনায় ২৬ হাজার ৭২৬ টন বেশি। এ মৌসুমে চিনি উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ১৯ টন। ২০২০-২১ মৌসুমে আখ মাড়াই হয় ৬৩ হাজার ৯৬৪ টন এবং চিনি উৎপাদন হয় ৩ হাজার ৬৬৪ দশমিক ৬০ টন। পরের মৌসুমে অর্থাৎ ২০২১-২২ মাড়াই মৌসুমে ২৪ হাজার ৩ টন আখ মাড়াই হয় এবং তা থেকে চিনি উৎপাদন হয় মাত্র ১ হাজার ৩০৮ টন। বর্তমানে চিনির মজুদ রয়েছে ১ হাজার ১৯ টন। ২০২২-২৩ মৌসুমে ২৬ হাজার ৪৫ টন আখ মাড়াই হয় এবং তা থেকে চিনি উৎপাদন হয় মাত্র ১ হাজার ৩৫৬ টন। গত বছরের চেয়ে এ বছর ২ হাজার ৪২ টন আখ বেশি উৎপাদন হয়েছে।
কৃষি প্রণোদনা হিসেবে আখচাষীরা সার, কীটনাশক ও এসটিটি পদ্ধতিতে আখ আবাদের জন্য আখের মুড়ি পাচ্ছেন। তার পরও আবাদ ও উৎপাদন কম। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রাজশাহী চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল বাশার বলেন, ‘২০২০ সালের প্রথম দিকে চাষীরা জানতে পারেন রাজশাহী চিনিকল বন্ধ হয়ে যাবে। এর পর থেকে চাষীরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আবার আমরা আখচাষীদের কাছে থেকে ১৮০ টাকা মূল্যে আখ ক্রয় করছি। কিন্তু তারা গুড় ব্যবসায়ীদের কাছে আখ বিক্রি করেন ২৫০-৩০০ টাকায়। তাদের কাছে থেকে সংগ্রহকৃত আখের দামও আমরা সময়মতো পরিশোধ করতে পারি না। তাই স্বাভাবিকভাবেই কৃষক আমাদের চেয়ে বাইরে আখ বিক্রি করতে পছন্দ করেন। এসব কারণে আমরা আখ সংকটে পড়ি। সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৮০ টাকার স্থলে ২২০ টাকায় চাষীদের কাছে থেকে আখ ক্রয় করার। এটি ২০২৩-২০২৪ মৌসুমে বেড়ে দাঁড়াবে ২৪০ টাকায়।’
আখ চাষের জমির পরিমাণ কমার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মিলের আশপাশে বেশ কয়েকটি ইটভাটা হয়েছে। এছাড়া পুকুর খনন করে মাছ চাষ হচ্ছে। আখ থেকে চাষীরা মুনাফা না পাওয়ায় অন্যান্য লাভজনক চাষে ঝুঁকছেন। আবার আখের দাম বাড়ানো, শহর বা নগরায়ণের প্রভাব এবং সার-কীটনাশকসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ার কারণে বহুলাংশে আখ চাষ কমেছে।’
রাজশাহীর কাটাখালী হাজরাপুকুর এলাকার আখচাষী মাসুদ রানা বলেন, ‘আমার দুই বিঘা জমিতে প্রতি বছরই আখ চাষ করছি। কিন্তু ইদানীং আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। দিন দিন সার, বীজ, কীটনাশকসহ শ্রমিকের খরচ বাড়ছে। জমি থেকে আখ কেটে মিল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে যে গাড়ি ভাড়া লাগত, সেটিও বেড়েছে। খরচ বাড়লেও বাড়েনি আখের দাম। তাছাড়া সরকার যে ভর্তুকি দেয় তা আমাদের জন্য পর্যাপ্ত না। আমরা আখ চাষ না করলে মিলও অচল হয়ে যাবে। তাই সরকারের উচিত আখের দাম বাড়ানো এবং আমাদের প্রয়োজনীয় কৃষি সহায়তা দেয়া।’
সম্ভাবনা বা উন্নয়নের ব্যাপারে রাজশাহী চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল বাশার বলেন, ‘রাজশাহী চিনিকলে বছরের অর্ধেকের কম সময় আখ মাড়াই চলে। বাকি সময় বন্ধ থাকে। ওই সময় আমরা অন্যান্য সহযোগী পণ্য উৎপাদন ও বিপণন করতে পারি। যেমন—ম্যাংগো জুস, ডিস্টিলারি স্থাপন কিংবা কো-জেনারেশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন। যেহেতু আমাদের জায়গা, শ্রমিক ও সময় সবই আছে, সেহেতু এ প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের তরফ থেকে সরকারকে এসব প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি চীনারা এসেছিল কোনো একটি প্রকল্প নিয়ে। তবে এ সবই সরকারপ্রধানের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।