ধর্ম ডেস্ক : প্রতিবন্ধী বলতে আমরা বুঝি, অঙ্গহানির কারণে যারা শারীরিকভাবে অসুস্থ বা যাদের দেহের কোনো অংশ কিংবা তন্ত্র আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে, ক্ষণস্থায়ী কিংবা চিরস্থায়ীভাবে স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়েছে।
প্রতিবন্ধীরাও মহান আল্লাহর সৃষ্টি। মহান আল্লাহ বিশেষ হেকমতে তাদের সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিকুলের কিছু অংশকে আমরা অনেক সময় অস্বাভাবিক ও অসুস্থ দেখতে পাই।
এর রহস্য ও কল্যাণ আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। একটি কারণ হলো—বান্দা যেন আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে এবং বুঝতে পারে যে তিনি সব বিষয়ে ক্ষমতাবান। তিনি যেমন স্বাভাবিক সুন্দর সৃষ্টি করতে সক্ষম, তেমন তিনি এর ব্যতিক্রমও করতে সক্ষম।
প্রতিবন্ধীকে আল্লাহ তাআলা এই বিপদের বিনিময়ে তাঁর সন্তুষ্টি, দয়া, ক্ষমা ও জান্নাত দিতে চান।
হাদিসে কুদসিতে এসেছে, নবী (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি (আল্লাহ) যার দুই প্রিয়কে (দুই চোখ) নিয়ে নিই, অতঃপর সে ধৈর্য ধরে এবং নেকির আশা করে, তাহলে আমি তার জন্য এর বিনিময়ে জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুতে সন্তুষ্ট হবো না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪০১)
প্রতিবন্ধীর প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি পাশ্চাত্য চিন্তাধারার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এসব শারীরিক অক্ষম ও প্রতিবন্ধী রাষ্ট্র, সমাজ ও ধনীদের থেকে সাহায্য-সহযোগিতা, ভালোবাসা ও অনুগ্রহ পাবে। হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ দয়ালুদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন।
যারা জমিনে বসবাস করছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো, তাহলে যিনি আকাশে আছেন, তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। যে ব্যক্তি দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে, আল্লাহও তার সঙ্গে নিজ সম্পর্ক বজায় রাখেন। যে ব্যক্তি দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহও তার সঙ্গে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯২৪)
ইসলাম প্রতিবন্ধী, অক্ষম ও দুর্বল ব্যক্তিদের অনেক কঠিন কাজ সহজ করে দিয়েছে এবং তাদের থেকে কষ্ট দূর করার বিধান দিয়েছে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে—ঘুমন্ত ব্যক্তি, যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়, নাবালেগ—যতক্ষণ না সে বালেগ হয় এবং পাগল—যতক্ষণ না সে জ্ঞান ফিরে পায় বা সুস্থ হয়।’
(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৪১)
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কোনো মানুষকে পথ না দেখিয়ে বিপথগামী করা, তাদের অনর্থক কষ্ট দেওয়া ও উপহাস করা থেকে নবী (সা.) কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, ‘সেই ব্যক্তি অভিশপ্ত, যে অন্ধকে পথ ভুলিয়ে দিল।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৮৭৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে প্রতিন্ধীরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর মুসলিম খলিফারাও প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে তাঁর পথ অনুসরণ করেন। তাঁরা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবন্ধীদের শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক ও তাদের সব ধরনের প্রয়োজন পূরণ করেছেন। খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) সব প্রদেশে ফরমান জারি করেন, সব অন্ধ, অক্ষম, প্লেগ রোগী ও এমন অঙ্গবৈকল্য, যা তাকে সালাতে যেতে বাধা দেয়, তাদের পরিসংখ্যান তৈরির আদেশ দেন। ফলে তারা এসব লোকের তালিকা করে খলিফার কাছে পেশ করলে তিনি প্রত্যেক অন্ধের জন্য একজন সাহায্যকারী নিয়োগ করেন, আর প্রতি দুজন প্রতিবন্ধীর জন্য একজন খাদেম নিযুক্ত করেন, যে তাদের দেখাশোনা ও সেবা করবে।
উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিকও প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কাজ করেন। তিনি সর্বপ্রথম প্রতিবন্ধীদের দেখাশোনার জন্য বিশেষ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ৮৮ হিজরি মোতাবেক ৭০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষাকেন্দ্রে ডাক্তার ও সেবক নিয়োগ করেন। প্রতিবন্ধীদের নিয়মিত ভাতা প্রদান করেন। সব অক্ষম, পঙ্গু ও অন্ধের জন্য খাদেম নিযুক্ত করেন।
মানুষের চেহারা নয়, কাজ গুরুত্বপূর্ণ
আল্লাহর কাছে মানুষের কর্ম গ্রহণযোগ্য, মানুষের দৈহিক গঠন, অর্থ-সম্পদ কিংবা সৌন্দর্য বিবেচ্য নয়। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের অবয়ব দেখেন না। তোমাদের আকার-আকৃতিও দেখেন না। তবে তিনি তোমাদের অন্তর ও কর্মগুলো দেখেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৪)
প্রতিবন্ধীদের ইসলামের বিধান পালনের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দিয়েছে ইসলাম। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৮৬)
প্রতিবন্ধীদের জন্য ইসলামে আছে সহনশীল বিধানের সুব্যবস্থা। এগুলো হলো মহান আল্লাহর অনুগ্রহ বিশেষ। পবিত্র কোরআনের বিঘোষিত নীতি হলো, ‘অন্ধের জন্য দোষ নেই, খোঁড়ার জন্য দোষ নেই, পীড়িতের জন্য দোষ নেই আর তোমাদের জন্যও দোষ নেই খাদ্য গ্রহণ করতে তোমাদের গৃহে কিংবা তোমাদের পিতৃগণের গৃহে কিংবা তোমাদের মাতৃগণের গৃহে কিংবা তোমাদের ভ্রাতাদের গৃহে কিংবা তোমাদের বোনেদের গৃহে কিংবা তোমাদের চাচাদের গৃহে কিংবা তোমাদের ফুফুদের গৃহে কিংবা তোমাদের মামাদের গৃহে কিংবা তোমাদের খালাদের গৃহে কিংবা ওই সমস্ত গৃহে, যেগুলোর চাবি আছে তোমাদের হাতে কিংবা তোমাদের বিশ্বস্ত বন্ধুদের গৃহে। তোমরা একত্রে আহার করো কিংবা আলাদা আলাদা, তাতে তোমাদের ওপর কোনো দোষ নেই। যখন তোমরা গৃহে, প্রবেশ করবে তখন তোমরা স্বজনদের সালাম জানাবে, যা আল্লাহর দৃষ্টিতে বরকতময় পবিত্র সম্ভাষণ। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্দেশসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা বুঝতে পার।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৬১)
প্রতিবন্ধী হয়েও ইসলামের ইতিহাসে সম্মান ও খ্যাতি অর্জন করেন বহু মনীষী যেমন—
১. আবদুল্লাহ ইবনে মাকতুম (রা.)-কে ১৪ বার মদিনায় স্থলাভিষিক্ত করেন। অথচ তিনি ছিলেন অন্ধ। তাঁর ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আবাসা নামের একটি সুরায় আলোচনা করা হয়েছে।
২. মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) পঙ্গু ছিলেন। তাঁকে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে প্রেরণ করেন
৩. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) শেষ জীবনে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার পরও তিনি কোরআনের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার ও সমকালের শ্রেষ্ঠ হাদিসবিশারদের মর্যাদা অর্জন করেন।
৪. শ্রেষ্ঠ তাবেঈদের অন্যতম আতা (রহ.) কৃষ্ণাঙ্গ, অন্ধ ও বোঁচা নাকের অধিকারী ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর হাত ছিল পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং পা ছিল ল্যাংড়া।
ওপেনএআই ও গুগলকে টেক্কা দিতে ৬৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা মেটার
কারো প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য নয়
মানুষ হিসেবে সবার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকা উচিত। সবার প্রাপ্য অধিকার দেওয়া জরুরি। ইসলামে যেকোনো ধরনের অক্ষম ব্যক্তির প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিপদগ্রস্ত, অসহায়-বিপন্ন বা প্রতিবন্ধীদের প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কেননা আল্লাহ অনুগ্রহ করে আমাদের সুস্থ-সবল করেছেন। তাই কাউকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ কোরো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না, ঈমানের পর মন্দ নাম অতি নিকৃষ্ট, আর যারা তাওবা করে না তারাই জালিম।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১১)
কাসেম শরীফ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।