বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : মহাবিশ্বের আকার-আকৃতি এতই বড় যে আমাদের পরিচিত দূরত্বের একক মিটার-মাইল দিয়ে পরিমাপ করলে তা আমাদের অনুভূতিতে অল্পই ধরা দেবে। অবশ্য পৃথিবীতে ব্যবহারের জন্য তারা বেশ উপযোগী। এর বদলে আমরা দূরত্ব পরিমাপ করব আলোর বেগের মাধ্যমে। এক সেকেন্ডে আলোকরশ্মি ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল অথবা প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে, অথবা সাতবার প্রদিক্ষণ করে পৃথিবীকে।
সূর্য হতে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে প্রায় ৮মিনিট। এ কারণে আমরা বলতে পারি, সূর্য পৃথিবী হতে ৮ আলোকমিনিট দূরে। এক বছরে আলো মহাশূন্যে পথ অতিক্রম করে ১০ লক্ষ কোটি কিলোমিটার অথবা ৬ লক্ষ কোটি মাইল। যে দূরত্বটি আলো এক বছরে অতিক্রম করতে পারে, তাকে এক আলোকবর্ষ বলে, এটা দৈর্ঘ্যের একক। এই একক দিয়ে সময় নয় বরং দূরত্ব পরিমাপ করা হয়—বিশাল দূরত্ব।
পৃথিবীটা একটা জায়গা সত্যি, কিন্তু এটা শুধু একটা জায়গা নয়। এমন কি কোনো সাধারণ জায়গাও নয় এটা। কোনো গ্রহ অথবা গ্যালাক্সিও সাধারণ নয়। কারণ মহাবিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলই খালি। এই সীমাহীন শীতল বিশ্বজনীন শূন্যতার ভেতর সাধারণ বলতে যদি কিছু বোঝানো যায়, তবে তা অন্তহীন রাত্রিতে নিমজ্জিত আন্তঃগ্যালাক্সীয় শূন্যতা, যা এতই অদ্ভুত আর ঊষর যে এর তুলনায় গ্রহ-নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সিগুলোকে অসম্ভব সুন্দর মনে হয়; অথচ এদের নিতান্তই কম উপস্থিতি বড় পীড়াদায়ক।
এই মহাবিশ্বের যেকোনো জায়গায় যদি আর্বিভূত হবার সম্ভাবনা সমান হতো, তবে কোথাও আর্বিভূত হওয়ার পর কোনো গ্রহপৃষ্ঠে বা তার কাছাকাছি আছি—এমনটা হবার সম্ভাবনা হতো অত্যন্ত কম। শত লক্ষ কোটিতে এক (১০৩৩)—একের পর ৩৩টা শূন্য বসালে যে সংখ্যা হয়, তা। দৈনন্দিন জীবনে এ ধরনের ছোট সম্ভাবনাগুলো অসম্ভব বলে ধরা যায়। সুতরাং জায়গাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা যদি আন্তঃগ্যালাক্সীয় অবস্থান থেকে তাকাই, তাহলে দেখব অগণিত বিবর্ণ, খড়ের আঁটির মতো আলোর কুণ্ডালাকার ও লতানো অঙ্গ, সাগরের ফেনার মতো ভাসমান। এগুলোই গ্যালাক্সি। এর কিছু আবার নিঃসঙ্গ পথিক। তবে বেশিরভাগই দল বেঁধে বিশৃঙ্খলভাবে গাদাগাদি করে ছুটে চলেছে মহাজাগতিক মহাআঁধারের ভেতর দিয়ে। আমাদের সামনে মহাবিশ্বটা বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে বিরাজমান। আমরা অবস্থান করছি নীহারিকাপুঞ্জের জগতে, যা পৃথিবী হতে ৮০০ কোটি আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং পরিচিত বিশ্বের অর্ধপথ মাত্র।
ধূলিকণা, গ্যাস, আর নক্ষত্রের সমন্বয়ে তৈরি হয় একটি গ্যালাক্সি—শতকোটির ওপরে শতকোটি নক্ষত্র। প্রত্যেকটি নক্ষত্রকেই কারও কারও কাছে সূর্য মনে হতে পারে। কিন্তু কার্ল সাগান বলেন, গ্যালাক্সিতে রয়েছে নক্ষত্র ও পৃথিবীর মতো গ্রহ। এর অনেকগুলোতে হয়তো প্রাণী, বুদ্ধিমান প্রাণী এমনকি আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমনের উপযোগী সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে। কিন্তু দূর থেকে দেখলে গ্যালাক্সি আমাকে মনে করিয়ে দেয় মহাসমুদ্রের ঝিনুক অথবা প্রবালের কথা, মহাজাগতিক সমুদ্রে যা তৈরি করতে প্রকৃতির লেগে গেছে মহাকালের এক বিশাল অংশ।
কয়েক হাজার কোটি (১০১১—একের পর ১১টি শূন্য বসালে যে সংখ্যা হয়, তা) গ্যালাক্সি আছে এই মহাবিশ্বে, যার প্রতিটিতে গড়ে ১০ হাজার কোটি নক্ষত্র আছে। বর্তমানে আমরা অবশ্য জানি লাখো কোটি গ্যালাক্সি রয়েছে। সকল গ্যালাক্সিতে সম্ভবত যতগুলো নক্ষত্র আছে, অন্তত ততগুলোই গ্রহ আছে। অর্থাৎ, সংখ্যাটা হবে একশ কোটি কোটি কোটি (১০২৩—একের পর ২৩টি শূন্য বসালে যে সংখ্যা হয়, তা)।
এ ধরনের বিশাল সংখ্যার সামনে কতটুকু সম্ভাবনা ঈঙ্গিত করে যে শুধু সূর্যের মতো একটি সাধারণ নক্ষত্রের কেবল প্রাণী অধ্যুষিত গ্রহ থাকবে? মহাবিশ্বের এরকম একটি সাধারণ অঞ্চলে অবস্থান করেও কেন আমরা এত ভাগ্যবান হব? আমার মনে হয়, বিশ্ব খুব সম্ভবত প্রাণের বন্যায় ভাসছে। কিন্তু আমরা মানুষেরা হয়তো তা জানি না। পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে আমরা সবে অভিযান শুরু করেছি।
আটশ কোটি আলোকবর্ষ দূর হতে এমন কি গ্যালাক্সিপুঞ্জকেও যদি খুঁজতে বলা হয়, তাহলে তাও দেখা হবে খুবই কষ্টকর। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিও এই গ্যালাক্সিপুঞ্জের অন্তর্ভূক্ত। তার মানে, সূর্য আর প্রাণী দেখা আরও কঠিন। প্রাণী অধ্যুষিত এই একমাত্র গ্রহ সম্পর্কে আমরা নিশ্চিতভাবে জানি। এ গ্রহটা শিলা ও ধাতুকণা দিয়ে গঠিত। সূর্যের আলোর প্রতিফলনে ক্ষীণ আলোক প্রভা বিকিরণ করে। কিন্তু মহাজাগতিক এই বিশাল দূরত্বের আবর্তে গ্রহটা সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়।
বর্তমানে আমাদের দৃষ্টি আমাদেরকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, যাকে পৃথিবীর জ্যোতির্বিদরা গ্যালাক্সিগুলোর স্থানীয় দল বা লোকাল গ্রুপ বলে ডাকতে পছন্দ করেন। এটা ২০ থেকে ৩০ লক্ষ আলোকবর্ষ ব্যাপ্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গোটা ২০টা গ্যালাক্সির সমন্বয়ে গঠিত লোকাল গ্রুপ। সেগুলো আসলে কিছুটা বিক্ষিপ্ত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং সাদামাটা গ্যালাক্সিপুঞ্জ।
এই গ্যালাক্সিগুলোর একটি হলো এম৩১, যাকে আমরা ডাকি এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি নামে। অন্যান্য সর্পিল গ্যালাক্সির মতো গ্যাস ও ধুলিকণার সমন্বয়ে তৈরি এই বিশাল পিনহোয়েল নক্ষত্রপুঞ্জ—গ্যালাক্সি এম৩১-এর দুটি ছোট উপ-গ্যালাক্সি আছে। কার্ল সাগান বলেন, এই বামন উপবৃত্তকার উপ-গ্যালাক্সি দুটো মূল গ্যালাক্সির সঙ্গে মহাকর্ষীয় বন্ধনে আবদ্ধ পদার্থবিজ্ঞানের সেই একই নিয়মের মাধ্যমে, যে নিয়ম আমাকে চেয়ারে বসতে সাহায্য করে। প্রকৃতির নিয়মকানুন মহাবিশ্বের সবখানে একইরকম।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।