আন্তর্জাতিক ডেস্ক : রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই সপ্তাহেই উত্তর কোরিয়া সফর করতে পারেন বলে তুমুল জল্পনা ছিল। অবশেষে সোমবার ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে, পুতিন মঙ্গলবারেই উত্তর কোরিয়া সফরে যাচ্ছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইওন সুক ইওলের কাজাখস্তানে রাষ্ট্রীয় সফর ঘিরে গত বুধবার প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ে এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। সেখানেই কথাপ্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট পুতিনের উত্তর কোরিয়া সফরের বিষয়টি জানান তিনি।
যদি পুতিন উত্তর কোরিয়া সফর করেন, তাহলে সেটা হবে দীর্ঘ ২৪ বছর পর তার প্রথম সফর। সর্বশেষ ২০০০ সালে উত্তর কোরিয়া গিয়েছিলেন তিনি। তখন কিম জং উনের বাবা কিম জং ইল ক্ষমতায় ছিলেন। উত্তর কোরিয়া সফরের জন্য কিমের আমন্ত্রণটি গত বছরের সেপ্টেম্বরে গ্রহণ করেন পুতিন।
ওই সময় দুই নেতা রাশিয়ার পূর্ব সীমান্তে ভস্তোচনি কসমোড্রোমে বৈঠক করেছিলেন।
রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার দুই নেতার গত বছরের ওই বৈঠকটা দেখা হয় দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপনের প্রক্রিয়া হিসেবে। আর এবারের সফরকে বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের বন্ধন আরো দৃঢ় হয়েছে সেটা বোঝানোর উপলক্ষ।
মনে করা হচ্ছে, এই সফরে প্রধান আগ্রহ থাকবে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে কিভাবে সামরিক সহযোগিতা বাড়ানো যায় সেই দিকে।
একই সঙ্গে অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন- অর্থনীতি, সংস্কৃতি, কৃষি, পর্যটন ও সামাজিক নানা বিষয়েও পারস্পরিক আদান-প্রদান বাড়ানো যায় সেদিকেও নজর থাকবে।
বিশেষ করে সবচেয়ে আগ্রহ থাকবে কখন প্রেসিডেন্ট পুতিন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে অত্যাধুনিক অস্ত্র আদান-প্রদান করবে। সব মিলে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার এই দ্বিপক্ষীয় বৈঠক থেকে শুধু আলোচনা নয়, বরং সত্যিকারের ফলাফল আসবে বলে অনেকেই মনে করছেন।
আমরা এ ক্ষেত্রে তিনটি কারণ তুলে ধরব, যা আসলে পুতিন ও কিমের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে।
সামরিক সহযোগিতা : রাশিয়ার চাই অস্ত্র, উত্তর কোরিয়ার দরকার কারিগরি সাহায্য
ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান শুরুর প্রায় আড়াই বছর পর উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
কারণ দুই দেশই পরস্পরকে নানা সহায়তা সরবরাহ করছে।
কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিফিকেশন ও ডিপ্লোম্যাসির অধ্যাপক নাম সাং উক বলেন, এই মুহূর্তে বৈঠকের অ্যাজেন্ডা থাকবে, উত্তর কোরিয়ার তৈরি আরো কী পরিমাণ অস্ত্র ভবিষ্যতে রাশিয়ায় সরবরাহ করা হবে তা।
অন্য অনেকের মতে, বৈঠকটি শুধু সামরিক কিছু চুক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং কী করে উত্তর কোরিয়া গতানুগতিক সব অস্ত্রও সরবরাহ চালু রাখতে পারে ও যৌথভাবে অস্ত্র তৈরির প্রকল্পের মাধ্যমে দুই দেশের সামরিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় করা যায় সেটাও আলোচনায় থাকে।
আরো ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়ায় সরবরাহ করা অস্ত্রের বদলে উত্তর কোরিয়া শুধু জ্বালানি আর খাবারের বিনিময়ে সন্তুষ্ট থাকবে না। উত্তর কোরিয়ার লক্ষ্য থাকবে, কিভাবে তারা মহাকাশ প্রযুক্তির ব্যাপারে সহযোগিতা পেতে পারে। এর মানে হলো আরো স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য রাশিয়ার সাহায্য চাই উত্তর কোরিয়ার। এ ছাড়া পারমাণবিক সাবমেরিন ও স্যাটেলাইট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রাশিয়ার কাছ থেকে সাহায্য চাইতে পারে উত্তর কোরিয়া।
তবে একই সঙ্গে প্রফেসর নাম মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের বিনিময়ের বিষয়টি কখনোই প্রকাশ করা হবে না। সম্প্রতি ইউক্রেনে পশ্চিমা অস্ত্র প্রবেশ ও রাশিয়ার জন্য সেগুলো হুমকি হয়ে ওঠার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট পুতিন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এমনকি তিনি প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনার কথাও বলেছেন।
তবে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র বিনিময় বা এ নিয়ে সহযোগিতার বিষয়টি কোরিয়ান পেনিনসুলা ও উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো দেশগুলো থেকে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।
আর সে কারণেই ধারণা করা যায়, এই বৈঠকে পারমাণবিক ইস্যুতে কোনো আলোচনাই হয়তো সেভাবে প্রকাশ করা হবে না।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা : রাশিয়ার চাই শ্রমিক, উত্তর কোরিয়া চায় বিদেশি অর্থ
রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ায় কী করে অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরো বাড়ানো যায়, সেই বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই আলোচনা করবে।
দং-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও কূটনীতির অধ্যাপক ক্যাং দং ওয়ান বলেন, এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়ার যেটা রাশিয়ার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি দরকার তা হলো- কোরিয়ার শ্রমিকদের রাশিয়ায় গিয়ে বিদেশি মুদ্রা আয় করা। এর মানে হলো- রাশিয়ায় আরো শ্রমিক পাঠানোর সংখ্যাটা বাড়তে পারে। যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো পুনর্নির্মাণের জন্য রাশিয়ারও জনশক্তি দরকার।
এ ছাড়া অর্থনীতি আবারও আগের পথে ফিরিয়ে আনা ও যুদ্ধের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য রাশিয়ার প্রচুর কর্মী দরকার।
রাশিয়ান গণমাধ্যম ভেদোমস্তি এক কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে বলেছে, দুই নেতা এটা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন যে উত্তর কোরিয়া থেকে আরো শ্রমিক আনা যায় কি না। কারণ সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে থাকায় রাশিয়ায় ব্যাপক কর্মীসংকট চলছে।
কিন্তু উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল থেকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় বলা আছে, উত্তর কোরিয়ার কোনো শ্রমিক দেশের বাইরে কাজ করতে পারবে না।
ফলে নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্থায়ী সদস্য দেশ হিসেবে রাশিয়ার জন্য এটা কঠিন হবে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর কোরিয়ার কাছে শ্রমিক চাওয়াটা। কারণ এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তুষ্টি তৈরি করবে।
তাই মূলত নজর থাকবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কূটনৈতিক চাপ ও বিরোধীদের নানা চাপের মুখে দুই দেশ কী করে একে অপরের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা চালিয়ে নিতে পারে সে দিকে।
সংস্কৃতিবিনিময় : দুই দেশের পর্যটক চ্যানেল কি খোলা থাকবে?
উত্তর কোরিয়ায় পর্যটক পাঠানো শুরু করেছিল রাশিয়া। যা পরবর্তী সময়ে কভিড-১৯-এর জন্য বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু এ মাসের শুরু থেকে গত চার বছরের মধ্যে প্রথমবার রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন সার্ভিস শুরু হয়েছে।
রাশিয়ার প্রিমস্কি ক্রাই অঞ্চলের সরকারের হিসাব অনুযায়ী এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে চার শতাধিক রুশ পর্যটক উত্তর কোরিয়া ভ্রমণ করেছেন। রাশিয়ার ট্র্যাভেল এজেন্সি ভস্তোক ইন্ট্রু তাদের ওয়েবসাইটে উত্তর কোরিয়ায় পাঁচ দিন চার রাতের ট্যুর প্যাকেজ বিক্রি করছে ৭৫০ ইউএস ডলার করে। এ ছাড়া উত্তর কোরিয়ায় দলবদ্ধ ভ্রমণের অফারও আছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেটি চাইলে বুকিং দেওয়া যাবে।
এই পেজ থেকে পর্যটকদের নানা অফার দেওয়া আছে, তার মধ্যে রয়েছে বাকদু পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ, উত্তর কোরিয়ার ইতিহাস নিয়ে ট্যুর এবং উত্তর কোরিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধ জয়ের বার্ষিকীতে ভ্রমণ প্যাকেজ।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি পর্যটনে জোর দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ইউনিভার্সিটি অব নর্থ কোরিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক কিম দং ইয়াপ বলেন, পর্যটন শুধু বিদেশি মুদ্রা আয়ের ব্যাপার নয়, এটা মানুষের সঙ্গে মানুষের সরাসরি যোগাযোগে সম্পর্ক উন্নত করে।
তিনি আরো বলেন, রুশরা উত্তর কোরিয়া ভ্রমণ করছে এটা দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উপস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রফেসর কিম বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে উত্তর কোরিয়ার যে পরিচিতি, বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণ সেই ধারণাগুলো দূর করতে সাহায্য করবে।
এদিক থেকে উত্তর কোরিয়ায় পর্যটনকে দেখা হয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে। যা অর্থনীতির বাইরেও তাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নয়নের হাতিয়ার। তবে সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়ায় কিছু গ্রুপ ট্যুর বাতিলের ঘটনা ঘটেছে।
একটি ট্র্যাভেল এজেন্সি জানায়, তাদের এটা চার দিনের গ্রুপ ট্যুর, যা মে মাসের ৩১ তারিখ থেকে হওয়ার কথা ছিল, সেটা বাতিল হয়েছে পর্যাপ্ত আবেদন না থাকার কারণে। এ ছাড়া উত্তর কোরিয়ায় পর্যটকদের জন্য যথেষ্ট সুবিধা না থাকা ও বিদেশিদের চলাচল সীমিত থাকা এই সেক্টরের আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রফেসর ক্যাং দং ওয়ানের মতে, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার এই বৈঠক দুই দেশের পর্যটন নিয়ে আলোচনার একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।