স্পোর্টস ডেস্ক : ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ তথা বিশ্বকাপ উপলক্ষে ১.৫ মিলিয়ন মানুষের সমাগম হবে কাতারে। যা ছোট আরব দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি। ইতিমধ্যে ২.৫ মিলিয়ন টিকিট বিক্রি হয়েছে। সব আয়োজনও সম্পন্ন। ৩২ দলের ময়দানি লড়াইয়ের মঞ্চও প্রস্তুত। অপেক্ষা শেষ। আজ মাঠে গড়াচ্ছে ফুটবল ইতিহাসের ৮৮ বছরের ইতিহাসে প্রথম শীতকালীন বিশ্বকাপ।
যা মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব বিশ্বের প্রথম বিশ্বকাপ। এশিয়ার দ্বিতীয়। জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার পর এশিয়ার একমাত্র একক আয়োজনের বিশ্বকাপ। অবশ্য সবকিছু এতোটা সহজ কিংবা মসৃণ ছিল না। ছিল নানা চড়াই-উৎরাই। শঙ্কা আর অনিশ্চয়তার দোলাচল। নানামুখী চ্যালেঞ্জ আর প্রতিবন্ধকতার নাগপাশ।
বিশ্বকাপ-২০২২ এর আয়োজক নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। আয়োজক হতে আগ্রহ দেখায় সাতটি দেশ। তার মধ্যে ইন্দোনেশিয়া সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়ায় বাদ পড়ে। আর মেক্সিকো আর্থিক সমস্যার কারণ দেখিয়ে সরে দাঁড়ায়। বাকি থাকে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কাতার ও দক্ষিণ কোরিয়া। ২০১০ সালের ২ ডিসেম্বর ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক ঘোষণা করে ফিফা। চার রাউন্ডের হাড্ডাহাড্ডি ভোটাভুটি শেষে সবাইকে পেছনে ফেলে আয়োজক নির্বাচিত হয় কাতার। তাতে অবশ্য অনেকেই অবাক হয়। অবশ্য বিতর্কও ছড়ায় অনেক। অভিযোগ উঠে দুর্নীতির। ধারণা করা হয়, কাতার কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে ভোট ক্রয় করে ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক হয়। ফিফা সেটা বারবার অস্বীকার করলেও এরপর জল ঘোলা হয় অনেক। কিন্তু ফিফা বিশ্বকাপ কাতারে আয়োজন করার বিষয়ে দৃঢ় অবস্থানেই থাকে।
দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগে ২০১৫ সালে বরখাস্ত হন ১৭ বছর ফিফার সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সেপ ব্লাটার। এই অভিযোগে নিষিদ্ধ হন ব্লাটারের পর ফিফা সভাপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখা উয়েফা সভাপতি মিশেল প্লাতিনি, ফিফার সেক্রেটারি জেনারেল জেরোমে ভালকে ও ফিফার সাবেক সহ-সভাপতি চুং মুং-জুন। ফিফার গভর্নিং বডি এথিক্স কমিটি তাদের নিষিদ্ধ করে।
কাতারকে বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত করার বিষয়ে সেপ ব্লাটার ২০১০ সালে বলেছিলেন, ‘আরব বিশ্ব একটি বিশ্বকাপ আয়োজনের দাবিদার। তাদের রয়েছে ২২টি দেশ। কিন্তু আগে কখনোই তারা বড় কোনো টুর্নামেন্টের আয়োজক হয়নি।’
আয়োজক হওয়ার পর ২০১৪ ও ২০১৫ সালে দুটি ফিজিবিলিটি স্টাডি করে দেখা যায় জুন-জুলাইতে তীব্র গরম থাকে কাতারে। আর এই সময়ে সেখানে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করা সম্ভব নয়। তাই নতুন সিদ্ধান্ত হয় শীতকালে অর্থাৎ নভেম্বর-ডিসেম্বরে কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের। আবার বিশ্ব মেতে ওঠে সমালোচনায়, বিরোধিতায়। অবশ্য সেটার কারণও ছিল। নভেম্বর-ডিসেম্বরে অন্যান্য দেশগুলোতে লিগ চলে পুরোদমে। বিশ্বকাপের জন্য সেসব লিগে বিরতি পড়ে যাবে কমপক্ষে ৮ সপ্তাহের। এতে করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হবে। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের স্বার্থে, খেলোয়াড়দের স্বার্থে সব পক্ষ শীতকালে বিশ্বকাপ আয়োজনে রাজি হয়। শীতকালে হলেও মরুভূমির প্রচণ্ড গরমে খেলার ক্লান্তি সহনীয় করে তুলতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণসহ সর্বাধুনিক সব যন্ত্রপাতি যেখানে যুক্ত করার ঘোষণা দেয় কাতার।
বিশ্বকাপ আয়োজন করতে কমপক্ষে ৮টি (সর্বোচ্চ ১২টি) স্টেডিয়ামের দরকার হয়। ২০১০ সালে কাতারের স্টেডিয়াম ছিল মাত্র তিনটি। এরপর তাদের নতুন করে আরও ৯টি স্টেডিয়াম নির্মাণ করতে হয়। পুরনো তিনটিকে ঢেলে সাজাতে হয়। স্টেডিয়াম ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের পেছনেই তাদের খরচ হয় ২২০ বিলিয়ন ডলার। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের এক বছর আগে কাতার ৮টি স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ পরিপূর্ণরুপে সম্পন্ন করে।
নতুন স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মাথায় শুরু আরেক সমালোচনা। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, প্রচণ্ড গরমের দেশ কাতারের দর্শক ও খেলোয়াড়দের জন্য আরামদায়ক স্টেডিয়াম নির্মাণ করতে গিয়ে এই গরমে রোদে পুড়ে কাজ করছে হাজারও শ্রমিক। সেখানে না মানা হচ্ছে কর্মঘণ্টা, না দেওয়া হচ্ছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিশ্রাম ও ছুটি। যা শ্রম আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
শুধু কি স্টেডিয়াম? বিশ্বকাপের সবকিছু ঝামেলামুক্ত করতে দেশটির বিমানবন্দরের আকার-আকৃতি বাড়ানো হয়, নতুন নতুন পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করতে হয়। বিশ্বকাপের নতুন নতুন ভেন্যুগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য নতুন রেললাইন ও হাইওয়ে নির্মাণ করতে হয়।
এসব নির্মাণ কাজের জন্য ২০ লাখের বেশি বিদেশি শ্রমিক কাজ করে। গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার দশ বছরের মধ্যে (২০১০-২০১৯) কাতারে ১৫ হাজার ২১ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তার মধ্যে বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ করতে গিয়ে মারা যায় ৬ হাজার ৭৫০ জন শ্রমিক। তার মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিক ছিল সহস্রাধিক। অবশ্য মারা যাওয়া শ্রমিকদের প্রকৃত সংখ্যা এখনও অজানা। আহত হওয়া শ্রমিকের সংখ্যা অসংখ্য। অবশ্য ফিফা আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
তার আগে ২০২১ সালের নভেম্বরে বিশ্বকাপের আয়োজক কমিটির প্রধান নির্বাহী নাসের আল-খাতের ঘোষণা দেন মেগা ইভেন্ট আয়োজনের জন্য তাদের ৮টি স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়েছে।
‘আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার এক বছর আগেই আমরা সবগুলো স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছি।’
অপেক্ষার পালা ফুরিয়ে, বছর-মাস পেরিয়ে, মরুর বুকে শুরু হচ্ছে ফুটবলের জয়গান। বিশ্বকাপ জ্বরে কাঁপছে পুরো বিশ্ব। সবার নজর কাতারের দিকে। ফুটবল বিশ্ব হবে কাতারমুখী। সমর্থন করা প্রিয় দল বিশ্বকাপে কেমন কী করবে, সেটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা আর হিসাব-নিকাশ মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে ফুটবলপ্রেমীরা। আর মরুভূমির বুকে বিশ্বকাপ আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে ব্যস্ত কাতার। ইতিহাসের প্রথম শীতকালীন বিশ্বকাপের আসর নিঃসন্দেহে ভিন্ন মর্যাদা পাবে।
আপনার অতি পছন্দের স্মার্টফোন পানিতে ভিজে গেলে দ্রুত যা করবেন
আর ৩২ দল ফুটবল নৈপূণ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে বিশ্বের শত শত কোটি মানুষকে নজরবন্দি করে রাখবে। কাতারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে গোটা ফুটবল বিশ্ব। গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ দেখতে মুখিয়ে পুরো ফুটবল বিশ্ব। আজ (২৯ নভেম্বর) থেকে শুরু হওয়া বিশ্বকাপের রঙে রঙিন হয়ে উঠছে পুরো বিশ্ব। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-উঁচু-নিচু সব বিভেদ ভুলে ফুটবলের জোয়ারে গা ভাসাবে সবাই। যেখানে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ। একই বৃন্তের মৃণাল ধরে বিকশিত হবে ফুটবল ও ফুটবল বিশ্ব। জয় হোক বিশ্বকাপের।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।