জুমবাংলা ডেস্ক : ডা. রায়হান শরীফ প্রচুর বিদেশি অ্যাকশন মুভি দেখতেন। সেটা তার আচরণে প্রকাশ পেত। তিনি ক্লাসে ছাত্রদের সামনে নিজেকে অ্যাকশন মুভির ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করতেন। সেসব সিনেমার সংলাপও বলতেন। গতকাল বুধবার শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া যায়। এদিকে শিক্ষার্থী আরাফাত আমিন তমালকে গুলি করার ঘটনায় শিক্ষক ডা. রায়হান শরীফকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, ডা. রায়হান শরীফের পারসোনাল একটি ব্যাগ থাকত। ওই ব্যাগ ভরা থাকত আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো চাকু। ব্যাগে ৬-৭টি মোবাইল ফোন থাকত। তিনি ক্লাসে প্রবেশ করে ব্যাগ থেকে দু-একটি অস্ত্র বের করে টেবিলে রাখতেন। তবে যেদিন বেশি রেগে থাকতেন, সব অস্ত্র টেবিলে রেখে ক্লাস করাতেন। শিক্ষার্থীরা তার ক্লাসে ভয়ে তটস্থ থাকত। তার ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকতে পারত না। কেউ ক্লাসে না এলে অন্য শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাসে পাঠিয়ে তাকে ডেকে আনতেন। এরপর তাকে নানাভাবে ভর্ৎসনা করতেন। প্রতিদিন ক্লাসে এসে কারও না কারও গায়ে হাত তুলতেন ডা. রায়হান। এটা তার নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়ে উঠেছিল।
শিক্ষার্থীরা আরও জানান, ডা. রায়হান শরীফ শিক্ষার্থীদের টাকায় চা-নাশতা কিনে আনতে বাধ্য করতেন। একবার পিকনিকের বাসে উঠে পিস্তল বের করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছেন। তখন এটাকে শিক্ষার্থীরা নিছক মজা হিসেবেই নেন।
এদিকে রায়হান শরীফ সম্পর্কে তথ্য জানতে শহরের বিএ কলেজ রোডে তাদের নিজস্ব বাসায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা জানান, শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে গুলির ঘটনার পর থেকেই তার পরিবারের কেউ বাসায় নেই। তবে কথা হয় সিরাজগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আশিক ইমরানের সঙ্গে। তিনি জানান, ৭-৮ দিন আগে শহরের মুক্তাপ্লাজার সামনে দিয়ে একটি রিকশা করে যাচ্ছিলেন রায়হান শরীফ। এ সময় অন্য একটি রিকশার সঙ্গে তাকে বহন করা রিকশাটির ধাক্কা লাগে। এ সময় রেগে গিয়ে ওই রিকশাওয়ালাকে চড় মারেন রায়হান। পরে ব্যাগের চেইন খুলে পিস্তল বের করে গালি দিতে দিতে চলে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ৫২তম ব্যাচের ছাত্র রায়হান শরীফ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। সেখান থেকে পাস করে বের হওয়ার পর ২০১৭ সালে নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। লিয়াকত নামে ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসকের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে চাকরিচ্যুত হন তিনি। এরপর বিসিএসে নিয়োগ পেয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে বদলি হয়ে চলে আসেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) সিরাজগঞ্জ শাখার সভাপতি ও নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জহুরুল হক রাজা বলেন, ‘ডা. রায়হান প্রায়ই অস্ত্র বের করে ভয় দেখাতেন। তার জন্য হাসপাতালে একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হতো। কয়েক বছর আগে হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. লিয়াকত আলীর মাথায় পিস্তল ধরে হত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন। এসব অভিযোগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরিচ্যুত করে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, আমাদের ছাত্র ছিল রায়হান শরীফ। যতটুকু দেখেছি, একটু উগ্র ও বেয়ারা টাইপের ছেলে ছিল। হুট করেই মাথা গরম করে। সিরাজগঞ্জ মনসুর আলী হাসপাতালের ঘটনাটি শিক্ষকদের জন্য খুবই লজ্জাজনক।
এদিকে গতকাল সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচির প্রস্তুতি নেন। তবে পুলিশ ও কলেজ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তারা এসব কর্মসূচি থেকে সরে আসেন। একপর্যায়ে অভিযুক্ত শিক্ষক রায়হান শরীফের সাময়িক বরখাস্তের খবরে আশ্বস্ত হয়ে ক্লাস বর্জন প্রত্যাহার করে নেন তারা।
কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আমিরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল শিক্ষক রায়হান শরীফ যাতে কলেজে না থাকেন। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগ ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। শিক্ষার্থীরাও তাদের ক্লাস বর্জনের আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
৭ দিনের রিমান্ড আবেদন: সিরাজগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মো. জুলহাজ উদ্দীন বলেন, ডা. রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী তমালের বাবা আব্দুল্লাহ আল-আমিন বাদী হয়ে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। ওই মামলায় মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক আব্দুল ওয়াদুদ বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে অন্য একটি মামলা করেন। এ মামলায় অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। তবে রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য হয়নি।
ডিবির ওসি আরও বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেছেন, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার এক ব্যক্তির কাছ থেকে অস্ত্রগুলো কিনেছেন। প্রতিটি পিস্তল তিনি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে কিনেছিলেন। তার কাছ থেকে পাওয়া সব অস্ত্রই ছিল অবৈধ। এসব অস্ত্র কেনা ও তা বহন করা তার একটা শখ বলে জানিয়েছেন। তার ফোনে অসংখ্য বিদেশি পিস্তলের ছবিও রয়েছে। সূত্র : কালবেলা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।