জুমবাংলা ডেস্ক : ফুল সৌন্দর্য ও ভালবাসার প্রতীক। ফুলকে ভালোবাসেন না এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাঠমালতি বা গাজরার মালা নারীদের অতি পছন্দের একটি জিনিস। যেকোনো অনুষ্ঠানে এই গাজরা খোপায় না দিলে সাজটাই যেন সম্পূর্ণ হয় না।
এক সময় কেবল বাড়ির আঙিনায় ফুল বাগান দেখা গেলেও বর্তমানে এর বাণিজ্যিক চাহিদা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসসহ নানা উৎসব-আনন্দানুষ্ঠানে ফুলের ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। তাই এখন দেশের বহু জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে। সৌন্দর্য আর ভালোবাসার প্রতীক ফুল চাষাবাদকে জীবিকার পাথেয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন অনেকে।
এরই অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য কাঠমালতি বা গাজরার বাগান গড়ে উঠেছে। রাজধানীর ফুলের দোকানগুলোতে যে গাজরার মালা শোভা পায় তার অনেকটাই রূপগঞ্জে উৎপাদিত। এ কাঠমালতির বাগান সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় অনেক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে।
রূপগঞ্জ উপজেলার জমি ও আবহাওয়া ফুল চাষের উপযোগী হওয়ায় স্থানীয় কৃষকরা আবাদি-অনাবাদি জমিতে ফুল চাষে ঝুঁকছেন। এছাড়া অন্য ফসলের চেয়ে ফুল চাষে তুলনামূলক লাভ বেশি হওয়ায় অনেক কৃষক আগ্রহী হচ্ছে।
কাঠমালতি ফুলের বাগান দেখতে অনেকটা চা বাগানের মতো। এ ফুল গাছ একবার রোপণ করলে ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত ফুল উৎপাদন করা যায়। প্রতিদিন সকালে এই কাঠমালতি ফুলের কলি সংগ্রহ করার দৃশ্যটি দেখে মনে হবে যেন, চা শ্রমিকরা চা পাতা তুলছেন।
রূপগঞ্জ উপজেলার তারাব পৌরসভার কিছু অংশসহ মুড়াপাড়া ও ভুলতা ইউনিয়নে কাঠমালতি ফুলের ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। এছাড়া উপজেলার গন্ধর্বপুর, বোচারবাগ, বংশিনগড়, বড়ৈইপাড়া, মাছুমাবাদ, দিঘীরপাড়, মিয়াবাড়ি, মুইরাব, হাটাব এলাকাজুড়ে রয়েছে এই কাঠমালতির বাগান।
বাগান থেকে কলি তুলে মালা তৈরি করে অর্থ উপার্জনের সুযোগ পাচ্ছেন বাগান এলাকার প্রায় কয়েকশ পরিবারের লোকজন। মালা তৈরির কারিগররা প্রতিদিন শিশির ভেজা ভোরে গাজরা ফুলের কলি তুলে মালা গাঁথার জন্য তাদের বাড়িতে নিয়ে যান। সারাদিন মালা গেঁথে বিকেলে মালাগুলো বাগান মালিকদের হাতে পৌঁছে দেন। কারিগরদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় সুঁইয়ের খোঁচায় তৈরি হয় বিচিত্র নকশার মালা। শীত মৌসুম এলে একটু বাড়তি আয়ের আশায় কাঠমালতির ফুল দিয়ে মালা বানানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন এলাকার নারী-পুরুষ এমনকী শিশু-কিশোররাও। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও সকালে কলি তুলে স্কুলে যায় আবার বিকেলে বাড়ি ফিরে মালা বানাতে বাবা-মাকে সহযোগিতা করে।
এসব ফুল তুলে মালা গাঁথা কারিগরদের পিসপ্রতি মজুরি দিতে হয়। প্রকার ভেদে প্রতিটি মালার জন্য তাদের দেওয়া হয় পাঁচ থেকে সাত টাকা করে। মৌসুমে সারাদিন একটানা কাজ করলে একজন কারিগর প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০টি মালা গাঁথতে পারেন। এতে একজন মালা তৈরির কারিগর সাংসারিকসহ অন্য কাজের ফাঁকেও প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করতে পারেন।
কাঠমালতি ফুলের মালা তৈরির সঙ্গে জড়িত রূপগঞ্জের প্রায় অর্ধশত পরিবার। গাজরার মালা প্রতিদিনেরটা প্রতিদিন বিকেলের মধ্যে চলে যায় রাজধানীর শাহবাগের কাঁটাবনে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ফুলের বাজার রাজধানীর শাহবাগ থেকে পাইকারি বিক্রেতাদের মাধ্যমে পৌঁছে যায় সারাদেশের ফুলপ্রেমী মানুষের কাছে। পাইকারি বাজারে প্রতিপিস গাজরার মালা ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে। সারাবছরই কমবেশি ফুলের চাহিদা থাকে তবে ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নিতে পহেলা ফাল্গুন, ভালবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ফুলের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এতে বছরের অন্য সময়ের মন্দাভাব পুষিয়ে নেন বাগান মালিক ও মালা গাঁথার কারিগররা।
গাজরার মালা তৈরির নারী কারিগর সবিতা রানী বলেন, তিন ছেলেমেয়েসহ পাঁচজনের সংসারে স্বামীর একার রোজগার দিয়ে চলতে কষ্ট হয়। তাই ঘরের কাজের পাশাপাশি গাজরা ফুলের মালা তৈরির কাজ করি। এতে আমার স্বামীর পাশাপাশি আমিও সংসার চালাতে সহযোগিতা করতে পারছি। লেখাপড়ার ফাঁকে বাচ্চারাও মালা গাঁথায় সহযোগিতা করে।
বোচারবাগ এলাকার বৃদ্ধা রাবেয়া বেগম বলেন, ‘পুত (ছেলে) নাই, মাইয়া বিয়া দিয়া দিছি। স্বামী তেমন কাম কাইজ করতে পারে না। তাই ফুলের মৌসুমে গাজরার মালা গাঁইথথা (গেঁথে) যা আয় হয় তা দিয়া ভালোই আছি। প্রতিদিন মালা গাঁইথথা ২০০ থেইক্কা ৩০০ টেহা (টাকা) আয় করবার পারি। এতেই আমগো চলে।’
গাজরার মালা তৈরির আরেক কারিগর মিরাজ মিয়া জানান, তিনি হাপানির রোগী, ভারী কাজকর্ম করতে পারেন না। তাই এ কাজে পরিশ্রম কম হওয়ায় গাজরার মালা তৈরি করেই তার সংসার চলে। শীতের মৌসুমে ফুলের চাহিদা বেশি থাকায় আয় রোজগারও একটু ভালো হয়। পাশাপাশি নিজের বাড়ির আঙিনায় শাক-সবজির চাষ করেন। এতে তার সংসার ভালোই চলছে।
কাঠমালতি (গাজরা) ফুল বাগানের মালিক নাইম বলেন, আমি গত এক যুগ ধরে গাজরার বাগান করে ফুলের ব্যবসা করছি। রূপগঞ্জের আরও কয়েকজন মিলে আমরা গাজরা ফুল ঢাকার শাহবাগে বিক্রি করি। ফুল তুলে মালা গাঁথা কারিগরদের মালার প্রকারভেদে পাঁচ থেকে সাত টাকা দিতে হয়। প্রতিপিস গাজরার মালা শাহবাগে ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। সব খরচ বাদ দিয়েও লাভের অংশ থেকে সংসার চালিয়েও কিছু আয় করতে পারছি।
তিনি বলেন, ভালবাসা দিবস, পহেলা বৈশাখ, থার্টি ফার্স্ট নাইট, শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ জাতীয় দিবস ও জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী, গায়ে হলুদ, গাড়ি সাজানো, বিভিন্ন ধরনের পূজা-পার্বণ ও সভা-সমাবেশ উপলক্ষে ফুলের কদর বেশি থাকে। এসময় ফুলের দাম একটু বেশি পাওয়া যায়।
রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফাতেহা নুর জানান, উপজেলায় প্রায় ১৬ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চাষাবাদ হচ্ছে। এর ভেতর অনেক এলাকায় কাঠমালতি ফুলের অসংখ্য বাগান রয়েছে। উপজেলায় উৎপন্ন ফুল রাজধানীর ফুল বাজারের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া তাদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফুল চাষিদের উপজেলা কৃষি অফিস থেকে পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।