একজন সাধারণ গৃহিনী থেকে দেশকান্ডারি হয়ে ওঠার অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে চলে গেলেন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান চরিত্র খালেদা জিয়া গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে নেমে দশ বছরের মধ্যেই বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়েছিলেন।
১৯৮১ সালের মে মাসে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয়, খালেদা জিয়া তখন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। রাজনীতি নিয়ে চিন্তাধারা তো দূরের কথা, রাজনৈতিক কোন অনুষ্ঠানেও তাকে খুব একটা দেখা যেতো না।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তবে তাার আগেই বিএনপির নেতাকর্র্মীরা বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আসার অনুরোধ জানান। কিন্ত তিনি তাতে সায় দেননি।
এক পর্যায়ে বিচারপতি সাত্তারকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। একদিকে দলীয় কোন্দল, অন্যদিকে বিএনপির অনেক নেতার এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগদান – এই দুই পরিস্থিতিতে বিএনপি তখন অনেকটা ছত্রভঙ্গ, বিপর্যস্ত এবং দিশেহারা।
দল টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে তৎকালীন বিএনপির সিনিয়র কিছু নেতার পরামর্শ এবং অনুরোধে ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া। এরশাদ বিরোধ আন্দোলনে তিনি হয়ে ওঠেন আপসহীন নেত্রী। তার নেতৃ্ত্বেই ক্ষমতা হারানো ৯ বছরের মধ্যে বিতর্কমুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে জনতার রায়ে ফের বিএনপি সরকার গঠন করে।
দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্যবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেল খেটেছেন। তবে কখনোই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন আপসহীন নেত্রী হিসেবে।
রাজনৈতিক জীবনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার মোট ৫ বার আটক হয়েছেন। এরমধ্যে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ৩ বার, ২০০৭ সালে মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের শাসনামলে একবার এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের শাসনামলে একবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন খালেদা জিয়া।
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি রাজনীতিতে যোগ দেয়ার পর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি তিন দফায় গ্রেপ্তার হন খালেদা জিয়া। তবে এই সময় তাকে বেশিদিন আটক থাকতে হয়নি।
২০০৭ সালে সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তা র করা হয়। তখন এক বছরের বেশি সময় কারাগারে থাকতে হয় খালেদা জিয়াকে। ২০০৬ সালে তার সরকারের নির্ধারিত শাসনকাল শেষ হওয়ার পর, ২০০৭ সালে নির্ধারিত নির্বাচন রাজনৈতিক সহিংসতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে বিলম্বিত হলে, সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। সেই সরকারের সময়কালে, খালেদা জিয়া তার দুই সন্তানসহ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন।
খালেদা জিয়াকে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দুর্নীতির মামলায় তার তৎকালীন ক্যান্টনমেন্টের মইনুল হক রোডের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বাসা থেকে তাকে সরাসরি সিএমএম আদালতে নিয়ে গিয়ে খালেদার আইনজীবীরা জামিনের আবেদন করলে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে জাতীয় সংসদ ভবন এলকার স্থাপিত বিশেষ সাব জেলে আটক করে রাখা হয় বেগম জিয়াকে। জেলে থাকার সময় ২০০৭ সালের ১৪ অক্টোবর মাসে তিনি ঈদুল ফিতর জেলেই পালন করেন। ঈদের দিন তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের স্ত্রী ও সন্তানরাসহ পরিবারের ১০ সদস্য খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেন। দেখা করার সময় পরিবারের পক্ষ থেকে ঈদের জন্য নতুন কাপড়, উন্নত খাবার ও ফুল দেয়া হয় তাকে। উল্লেখ্য, এই সময় তার দুই সন্তান তারেক রহমান ও প্রায়াত আরাফাত রহমানও জেলে ছিলেন।
এরপর ২০০৭ সালের ২১ ডিসেম্বর কোরবানির ঈদও ওই সাব জেলেই পালন করার পর ২০০৮ সালের ১৮ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার মা দিনাজপুরের বাসায় মৃত্যুবরণ করলে পরের দিন ১৮ জানুয়ারি তার লাশ হেলিকপ্টারে করে মইনুল রোডের বাসায় নিয়ে আসা হয়। ৬ ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়ে মায়ের লাশ দেখতে বাসায় যান খালেদা জিয়া।। তারপর প্রায় ৯ মাস পর ২০০৮ সালের ১ জুন খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির করা হয়। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এই সাব জেলে ৩৭২ দিন কাটানোর পর তিনি জামিনে মুক্তি পান।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা এবং ২০জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জিয়াকে২০১৮ সালে মোট ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রথমে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড কারাগারে বন্দি ছিলেন খালেদা জিয়া। পরে স্বাস্থ্যগত কারণে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে রাখা হয়। প্রায় দীর্ঘ ২ বছরেরও বেশি সময় তিনি কার্যত কারাগারে ছিলেন। ২৫ মার্চ ২০২০-এ সরকার শর্তসাপেক্ষে তাকে মুক্তি দেয় (কারাগারের সাজা স্থগিত করে বাসায় চিকিৎসার অনুমতি দেয়)। তবে এটিও পুরোপুরি মুক্তি নয়, আইনি শর্তে গৃহবন্দিত্বের মতো অবস্থা ছিল। ২০২৪ সালের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত তাকে রাজনৈতিকভাবে বন্দি অবস্থায় রাখা হয়েছিল।
পরবর্তীতে জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাহী আদেশে খালেদার দণ্ড মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেন। ২০২৪ সালের ২৭ নভেম্বর খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলা থেকে খালাস পান।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।


