জুমবাংলা ডেস্ক : লালমনিরহাট শহরের কালীবাড়ি এলাকায় একই খতিয়ানের একই দাগের জমির একই আঙ্গিনায় রয়েছে পুরান বাজার জামে মসজিদ ও কালীবাড়ি সার্বজনীন মন্দির। প্রতিদিন মসজিদে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করছেন আর মন্দিরে চলছে ভক্তদের পূজার্চনা।
কোনও প্রকার ঝগড়া, বাকবিতণ্ডা, অভিযোগ বা অনুযোগ ছাড়াই যুগের পর যুগ একই আঙ্গিনায় মন্দির ও মসজিদে বিরাজ করছে ধর্মীয় সম্প্রীতি। এমন দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। একই আঙ্গিনায় মন্দির ও মসজিদ স্থাপন করেছে ধর্মীয় সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত।
মন্দিরটিতে রয়েছে শ্রী শ্রী কালী মূর্তি, দেবাদিদেব মহাদেব, শ্রী শ্রী বাবা লোকনাথ। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় স্বাভাবিক নিয়মে চলে পূজার্চনা। এখানে রয়েছে শ্রী শ্রী দুর্গা মন্দিরও। প্রতিবছর জাঁকজমক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় শারদীয় দুর্গা পূজা।
একই আঙ্গিনার পুরান বাজার জামে মসজিদটি জেলার ঐতিহ্যবাহী একটি মসজিদ। এখানে নামাজ আদায় করতে দূরদূরান্ত থেকেও মুসল্লিরা আসেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে এই মসজিদে সবসময় মুসল্লিদের ভিড় থাকে।
স্থানীয়রা বলছেন, কালীবাড়ি মন্দিরটি প্রায় ২০০ বছর পুরনো। তৎকালীন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে পূজার্চনা করতেন। তারা দেশ ছেড়ে চলে গেলেও মন্দিরটি থেকে যায় অক্ষত। পরবর্তীতে অবকাঠামোগত কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এই আঙ্গিনায় গড়ে উঠে একটি জামে মসজিদ। নাম দেওয়া হয় পুরান বাজার জামে মসজিদ। পরে, মুসল্লিদের সহযোগিতায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে মসজিদের অবকাঠামোতে। একসময় এলাকাটি হয়ে উঠে নয়নাভিরাম।
স্থানীয় ব্যবসায়ী খোরশেদ আলম দুলাল বলেন, ‘একই আঙ্গিনার মসজিদ ও মন্দির ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। আর এই সম্প্রীতির চিত্র স্বচক্ষে দেখার জন্য প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। অনেক সময় স্থানীয়দের কাছ থেকে দর্শনার্থীরা ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদ ও মন্দির সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুগের পর যুগ একই আঙ্গিনায় একই সঙ্গে মুসলিম ও হিন্দুরা নিজ নিজ ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করে আসছেন। কিন্তু, কোনও দিনই কোনো ধরনের সমস্যা বা রেষারেষি হয়নি। আমরা উভয় ধর্মের মানুষ এখানে হাসিমুখে থাকি, ধর্ম পালন করি।’
স্থানীয় ব্যবসায়ী গোবিন্দ চন্দ্র সাহা বলেন, একই আঙ্গিনায় মসজিদ ও মন্দির আর যুগের পর যুগ ধরে একই সঙ্গে চলছে ধর্মীয় আচার পালন। কিন্তু, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা পূজার্চনা করতে কোনদিনই কোনও বাঁধার মুখে পড়েননি। মন্দিরে বড় ধরনের ধর্মীয় উৎসবের আয়োজন করা হলে এখানকার মুসলিম সম্প্রদায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা করেন।
তিনি বলেন, ‘দেশ-বিদেশে কোথাও কোনও ধরনের ধর্মীয় সম্প্রীতি নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিলেও এখানে তার প্রভাব পড়েনি।’
রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা দর্শনার্থী কলেজ শিক্ষক মনোরমা রানী দাস (৫৫) বলেন, ‘অনেক আগেই একই আঙ্গিনার মন্দির ও মসজিদ আছে শুনেছিলাম। কিন্তু, দেখতে আসার সময় হয়নি। এখন সময় পেলাম তাই দেখতে এলাম। খুবই ভালো লাগছে, আমি মুগ্ধ। এমন দৃশ্য যদি সারাবিশ্বে থাকত তাহলে ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হতো না। বিরাজ করতে শুধু শান্তি আর শান্তি।’
গাইবান্ধা থেকে আসা অপর দর্শনার্থী এনজিও কর্মী খন্দকার আজাহার আলী (৫০)। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় সম্প্রীতি কি, ধর্মীয় সম্প্রীতি কাকে বলে আর তা কেমন হওয়া উচিৎ এটা জানার জন্য, দেখার জন্য সবার এখানে আসা উচিৎ।’
কথা হয় মসজিদের মুয়াজ্জিনের সঙ্গে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘মসজিদে আজান ও নামাজের সময় কোনও দিন কোনও সমস্যায় পড়তে হয় না। এ সময়টাতে মন্দিরে পূজার্চনা হলেও কোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজানো থেকে বিরত থাকেন তারা। মন্দিরের পুরোহিতের সঙ্গে আমার সবসময় কথা হয়, ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে আলোচনা হয়।’
মন্দিরের পুরোহিত সঞ্জয় কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘মন্দিরে নিয়মিত পূজার্চনা হয়। আজান ও নামাজের সময় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ রাখা হয়। ধর্মীয় সম্প্রীতির বিঘ্ন ঘটে এমন অবস্থার মধ্যে আমাকে কোনদিনই পড়তে হয়নি। বরং স্থানীয় মুসল্লিদের সহযোগিতা পেয়ে আসছি।’
তিনি বলেন, ‘এখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি অটুট ছিল, আছে আর ভবিষ্যতেও থাকবে। কোনো দিনই এই সম্প্রীতিতে কোনো দাগ পড়েনি আর পড়বেও না। সারাবিশ্বেও যদি ধর্মীয় সহিংসতা বাধে তবুও এখানকার ধর্মীয় সম্প্রীতি থাকবে অটুট। এটাই আমাদের বিশ্বাস।’
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক রকিব হায়দার বলেন, একই উঠানে মসজিদ ও মন্দির, এটি একটি বিরল দৃষ্টান্ত। এখানকার মানুষ সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন। যার প্রমাণ এক উঠানে কেন্দ্রীয় কালীবাড়ী মন্দির ও পুরান বাজার জামে মসজিদ।
টাঙ্গাইলের নাগরপুরে একই আঙিনায় নামাজ ও পূজা, সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।