জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত গবাদি পশুর কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃত জাত নেই। তবে এবার আশা দেখাচ্ছে আরসিসি (রেড ক্যাটল চিটাগাং) বা চট্টগ্রামের লাল গরু। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) গবেষকরা উন্মোচন করেছেন জাতটির জীবনরহস্য। জাত স্বীকৃতির জন্য ১১৮টি শর্তের সবকটিই ধাপে ধাপে পূরণ করেছে গবেষক দল। জাত ও জাতবিষয়ক জাতীয় কারিগরি নিয়ন্ত্রণ কমিটি (এনটিআরসি) সম্প্রতি রেড চিটাগাং ক্যাটলকে নতুন জাত হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সুপারিশ করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে।
রেড চিটাগাং ক্যাটল বাংলাদেশের একটি মূল্যবান জেনেটিক রিসোর্স। অপরিকল্পিত প্রজনন ও জাতটি সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় এবং কৃত্রিম সংকরায়ণের কারণে এ গরুর উৎপাদনশীলতা একসময় কমতে শুরু করে। এরপর কয়েক ধাপে বাকৃবি, বিএলআরআই ও বিভিন্ন সংস্থা আরসিসি গরু সংরক্ষণে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়। দীর্ঘ গবেষণা শেষে সম্প্রতি উন্মোচন করা হয় এর জীবনরহস্য। গবেষকের মধ্যে ছিলেন বাকৃবির জেনেটিকস অ্যান্ড অ্যানিমল ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া ও অধ্যাপক ড. শামসুল আলম ভূঁইয়া, বিএলআরআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম, গৌতম কুমার দেব, ফারহানা আফরোজ ও দুজন কোরিয়ান গবেষক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরসিসির জীবনরহস্য উন্মোচন ও জাত স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে দেশি জাতের গরুর সম্প্রসারণে নতুন দ্বার উন্মোচন হবে। গবেষকরা জানান, এ জাতের গাভি থেকে এক বিয়ানে ৫০০-৬০০ কেজি দুধ পাওয়া যায়। দুধে চর্বির পরিমাণ বেশি (৫ থেকে ৬% পর্যন্ত হয়)। সাধারণ ব্যবস্থাপনায়ও এ জাতের গরু থেকে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে এরা সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। ১০ বছরে এ জাতের গরু থেকে ছয়-সাতটি বাছুর পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের পাঁচ উপজেলায় (পটিয়া, রাউজান, চন্দনাইশ, আনোয়ারা, সাতকানিয়া) এ জাতের গরু পালনের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, এদের গর্ভধারণের হার বেশি, প্রায় প্রতি বছর বাছুর পাওয়া যায়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং প্রান্তিক চাষি পর্যায়েও এ জাতের গরুর খামার লাভজনক। এদের দৈনিক দুধ উৎপাদন সক্ষমতা ২ দশমিক ৭ লিটার, এক বিয়ানে দুধদানকাল ২১৫ দিন এবং এক বিয়ানে প্রাপ্ত দুধের পরিমাণ ৫৮১ লিটার। এসব সুবিধার জন্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র খামারিদের কাছে এ জাতটির বেশ চাহিদা রয়েছে।
বাকৃবির একদল গবেষকের তথ্যানুযায়ী, ২০০০ সালে দেশে রেড চিটাগাং ক্যাটলের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৪৮৯। আরসিসিকে দেশি জাত হিসেবে উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ৩৪ কোটি ৪২ লাখ টাকার একটি সরকারি প্রকল্পে যৌথভাবে কাজ শুরু করেন বাকৃবি ও বিএলআরআইয়ের গবেষকরা। প্রকল্পের অধীনে সারা দেশে আবার জরিপ হয়। এতে প্রায় ৪৫ হাজার গরু পাওয়া যায় আরসিসি জাতের। বাকৃবির ২০২১ সালের আরেক জরিপে দেখা যায়, সারা দেশে আরসিসির সংখ্যা ৬৭ হাজার ৬০০। প্রকল্প শেষে গবেষকরা দেখতে পান, জাত উন্নয়ন করা গাভি থেকে ৭-৮ লিটার দুধ পাওয়া যাচ্ছে। কিছু কিছু গাভি আবার ৯ থেকে সাড়ে ৯ লিটার দুধও দিচ্ছে। প্রকল্পটির মাধ্যমেই দেশি এ জাতটির জীবনরহস্য উন্মোচন করেন গবেষকরা। তিন দশকের বেশি সময় ধরে আরসিসি নিয়ে গবেষণা করছেন বাকৃবির জেনেটিকস অ্যান্ড অ্যানিমল ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া। তিনি বলেন, এ জাতের গরু অবাধ সংকরায়ণের ফলে হুমকির মধ্যে পড়েছিল। দেশি জাত সংরক্ষণের বিকল্প নেই। কারণ দেশি জাত না থাকলে পরবর্তী সময়ে সংকরায়ণও করা যাবে না।
বিএলআরআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আরসিসি জাতের গরু আমাদের দেশের নিজস্ব সম্পদ। দেশে প্রাণিসম্পদ খাতে এ পর্যন্ত কোনো স্বীকৃত জাত ছিল না। এই প্রথম কোনো জাত স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। এতে সারা বিশ্বই এখন জানবে বাংলাদেশে একটা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জাত আছে। এ গরুর খাদ্য ও অন্যান্য খরচ একেবারেই কম এবং মাংস ও দুধ খুবই সুস্বাদু। ফলে ভালোভাবে সম্প্রসারণ করা গেলে বেশি মূল্যে রপ্তানিরও সুযোগ তৈরি হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘৭-৮ লিটার দুধ দেওয়া আরসিসি সিমেন দিয়ে সংকরায়ণ করে সাড়ে ৪ হাজারের মতো বাছুর পেয়েছি। সেগুলোকে আরও উন্নত করতে পরবর্তী ধাপে গবেষণা করা হবে। এ ছাড়া ১০ হাজার সিমেন বিএলআরআইয়ের জিন ব্যাংকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এসব বাছুরের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। স্থানীয় গরুর পারফরম্যান্স এবং এসব খামারের গরুর পারফরম্যান্স নিয়ে ধাপে ধাপে গবেষণা করা হয়েছে। জাতটির সংরক্ষণ ও গবেষণা চালু থাকবে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।