জুমবাংলা ডেস্ক : রাজনৈতিক দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা নিশ্চিত করতে এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও সততা বাড়াতে আইন পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত দুই সংস্কার কমিশন।
এর মধ্যে, নির্বাচন সংস্কার কমিশন সুপারিশ হলো—দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় কমিটির নেতা নির্বাচন করা উচিত সাধারণ সদস্যদের গোপন ব্যালটে ভোটের মাধ্যমে। জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রেও একইভাবে তিন সদস্যের প্যানেল গঠন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে, রাজনৈতিক দলগুলোর তহবিলের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন আইনে পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত বুধবার জমা দেওয়া প্রতিবেদনে এসব সুপারিশের প্রস্তাব দিয়েছে সংস্কার কমিশন।
নির্বাচনী সংস্কার কমিশন ১৯৭২ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশে কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব এনেছে, যে আদেশের অধীনে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধিত হয়।
সংস্কার কমিশনের আরেকটি পরামর্শ হলো, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে শাস্তিপ্রাপ্তদের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বা দলের কোনো সদস্যপদ পাওয়ার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা।
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গুরুতর মানবাধিকার (বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন, সাংবাদিকদের বা মানবাধিকারকর্মীর ওপর হামলা) এবং গুরুতর দুর্নীতি, অর্থপাচারের অভিযোগে গুম কমিশন বা দুর্নীতি দমন কমিশন বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযুক্ত হলে তাদের সংবিধানের ৬৬(২)(ছ) অনুচ্ছেদের অধীনে একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করে সংসদ সদস্য হওয়া বা দলের কোনো সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য করা।
রাজনৈতিক দলের সদস্যদের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা এবং বছরে একবার হালনাগাদ করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
এছাড়া, রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক শাখা বা বিদেশি শাখা না রাখার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রার্থীকে অন্তত তিন বছর ধরে দলের সদস্য থাকতে হবে।
দলের সদস্যদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ১০০ টাকা সদস্য ফি এবং সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা অনুদান নেওয়া যাবে। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে এ অনুদান নিতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ট্যাক্স রিটার্নে তা প্রকাশ করতে হবে।
রাজনৈতিক দলের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিবন্ধিত দলগুলোর বার্ষিক আয়-ব্যয়ের প্রতিবেদন অডিটের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন সংস্কার কমিশন বলছে, নির্বাচনী ব্যয় প্রতি ভোটারের জন্য ১০ টাকা নির্ধারণ করা উচিত এবং এই ব্যয় ব্যাংকিং সিস্টেম বা মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে।
এতে বলা হয়, ইসিকে যথাযথভাবে এসব ব্যয় পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রার্থী ও দলের নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব অডিট করা হবে। কোনো অসঙ্গতি পাওয়া গেলে জরিমানা আরোপ করা যেতে পারে।
দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের পরামর্শ, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের অর্থায়ন এবং আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও দুদকের সহায়তায় ইসি নির্বাচনী হলফনামায় প্রার্থীদের দেওয়া তথ্য যাচাই করবে এবং প্রয়োজনে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবে।
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সব স্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাসের মধ্যে এবং পরে প্রতিবছর নিজের ও পরিবারের সদস্যদের আয়, সম্পদ বিবরণী ইসির কাছে জমা দেবে। ইসি এসব তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে।
এতে বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত দুর্নীতি বা অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দলীয় পদে বা নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন না দেওয়া।
দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে দলীয় পদ বা নির্বাচনে মনোনয়ন না দেওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব বিবেচনার জন্য ছেড়ে দিয়েছি। আমরা শুধু দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কথা বলিনি, যারা চাঁদাবাজি-দখলবাজির সঙ্গে যুক্ত তাদের কথাও বলেছি।’
‘আমরা দেখতে পাচ্ছি যারা চাঁদাবাজি-দখলবাজির সঙ্গে যুক্ত তাদের দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। সুতরাং আমরা আশা করতেই পারি, নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রেও এ বিষয়ে তার দৃঢ় থাকবেন,’ বলেন তিনি।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা বাড়ানো এবং আর্থিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধির প্রস্তাবগুলো ইতিবাচক। রাজনীতিতে কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে। তার তা না হলে গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলার কোনো অর্থ নেই।’
সাবেক এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘কিন্তু এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। আবার, নির্বাচন কমিশনের উচিত এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখা যেন দলগুলো তাদের আর্থিক কার্যক্রম স্বচ্ছ রাখে।’
এসব বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসিরউদ্দিন জানান, তারা নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সব সুপারিশ পর্যালোচনা করবেন।
রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ, রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতার ওপর।’
গণতন্ত্রের চর্চা নেই দলের ভেতর
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। রাজনৈতিক দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা না থাকলে দেশ গণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারবে না।’
গত দুই-তিন দশকের রাজনৈতিক চর্চায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় সবগুলো দলেই দেখা যায় কয়েক দশক ধরে শীর্ষ নেতৃত্বে একই ব্যক্তি। দলীয় কাউন্সিলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতৃত্বের পরিবর্তন হওয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে কাউন্সিলও হয় না নিয়মিত।
যখন কাউন্সিল হয় তখন প্রায়ই দেখা যায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা হয় লজ্জা পান বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নিরুৎসাহিত করা হয়।
এই ধরনের চর্চায় দল পরিচালনায় শীর্ষ নেতারা চরম কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন। জাতীয় নির্বাচন ও অন্যান্য নির্বাচনে তারা এককভাবে প্রার্থী নির্বাচন করেন এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিজেরাই নিয়ে থাকেন।
আবার, রাজনৈতিক দলগুলো অর্থায়ন কোথা থেকে আসে এবং তারা কীভাবে তা ব্যয় করে সে সম্পর্কেও এক ধরনের অন্ধকারে থাকে জনগণ।
রাজনৈতিক গবেষক অধ্যাপক রওনক জাহান তার ‘পলিটিক্যাল পার্টিস ইন বাংলাদেশ’ বইতে লিখেছেন, যারা গণতন্ত্র সুসংহত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার কথা বলেন, তারা দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চার বিষয়টিতেও জোর দেন।
তিনি বলেন, ‘নেতৃত্ব নির্বাচন, প্রার্থী মনোনয়ন ও দলের নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়া দেখলেই এটা বোঝা সম্ভব। বাংলাদেশের জন্য সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা হলো দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।