জুমবাংলা ডেস্ক : আমের বাহ্যিক সৌন্দর্য বাড়ানো, কৃষকদের কীটনাশক প্রয়োগ বাবদ খরচ কমানো ও বিদেশে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের লক্ষ্যে আমের রাজধানীখ্যাত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতিবছর বাড়ছে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের ব্যবহার। শতভাগ নিরাপদ আম উৎপাদনের উপায় হওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এ পদ্ধতি।
কৃষি বিভাগ থেকে জানা যায়, জেলায় এ বছর প্রায় সাড়ে ১০ কোটি আমে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়েছে। তবে বাড়তি সরবরাহ ও গাছে ফলন কম হওয়ায় চলতি মৌসুমে গত বছরের তুলনায় ফ্রুট ব্যাগিংয়ের দাম কম বলে জানান আমচাষিরা।
এ ছাড়া ফ্রুট ব্যাগিংয়ের ওপর আরোপ করা সরকারি ভ্যাট মওকুফের দাবি জানিয়েছেন বাগানমালিকরা। আমদানিনির্ভর ফ্রুট ব্যাগিংয়ে সরকারি ভুর্তকি দাবি কৃষকদের।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ও ফরমালিনের অভিযোগে বিপুল পরিমাণ আম নষ্ট হয়। নিরাপদ আম উৎপাদন নিশ্চিত না হওয়ায় বিদেশে আম রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া গত দুই বছরে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামলে অনেক চিন্তাভাবনা করে আম উৎপাদন, পরিচর্যা ও বাজারজাত করতে হয়েছে জেলার আমচাষিদের। তাই এবার ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রয়েছেন তারা।
পোকামাকড় দমনে কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে দেশের বাজারে ফ্রুট ব্যাগিংয়ে আমের চাহিদা থাকায় বিক্রিও বাড়ছে। আমদানি করা ব্যাগের সিংগভাগই চীন থেকে আসে। চলতি বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতি পিস ফ্রুট ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে ৩ টাকা থেকে ৩ টাকা ৭০ পয়সায়, যা গত বছর ছিল ৩ টাকা থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত।
অভিযোগ রয়েছে, আমচাষিদের চাহিদাকে পুঁজি করে নিম্নমানের ফ্রুট ব্যাগ বাজারজাত করে সাধারণ কৃষকদের ঠকায় মধ্যস্বত্বভোগীরা। তাই কৃষকদের দাবি, ফ্রুট ব্যাগ ও তার কাঁচামালকে প্রকৃত কৃষিজাত পণ্য হিসেবে ঘোষণা করে অধিক হারে বাজার মনিটরিং করার। এতে একদিকে যেমন নিরাপদ আম উৎপাদন নিশ্চিত সম্ভব হবে, তেমনি অন্যদিকে লাভবান হবেন আমচাষি, ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকরা।
বাগানমালিক আপন রেজা নিসান আলী বলেন, গত বছর ১০ বিঘার একটি বাগান নিয়েছি। ফজলি, আশ্বিনা, ল্যাংড়া, ক্ষীরসাপাত জাতের আম রয়েছে বাগানে। এসব আমে ১১ দিন আগে ফ্রুট ব্যাগিং সম্পন্ন করছি। এতে আমে কোনো দাগ থাকে না। কীটনাশক দিতে হয় না। আমের রংও খুব ভালো থাকে।
ফ্রুট ব্যাগিং করা শ্রমিক ভোলাহাটের তরিকুল ইসলাম বলেন, আমের সাইজ গুটি থেকে একটু মাঝারি হলেই বাগানমালিকরা ব্যাগিং করা শুরু করেন। প্রায় টানা ১৩ দিন বিভিন্ন বাগানে ফ্রুট ব্যাগিং করেছি। দুই-তিন বছর আগেও এত বেশি গাছে ব্যাগিং হতো না। তবে এ বছর প্রচুর পরিমাণে আমের ব্যাগিং হয়েছে। ছোট, মাঝারি, বড় সাইজের সিংহভাগ গাছেই ব্যাগিং করে অধিক লাভবান হচ্ছেন আমচাষিরা।
গত কয়েক বছর সুইডেন ও হংকংয়ে আম রাপ্তানি করছেন শিবগঞ্জ ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্যসচিব আহসান হাবীব। তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের সিংহভাগ হয় আশ্বিনা জাতের আমে। এই জাতের আমে যদি ফ্রুট ব্যাগিং না করা হয়, তাহলে অর্ধেক আম গাছেই পোকায় নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ফ্রুট ব্যাগিং করা হলে আম পাড়া পর্যন্ত নিশ্চিত থাকা যায়। এমনকি আমে কোনো প্রকার কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় না। ফলে উৎপাদন খরচও কমে যায়। এমনকি দামও বেশি পাওয়া যায়।
শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিডেটের সাধারণ সম্পাদক ও আম রপ্তানিকারক ইসমাঈল খান শামিম জানান, ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত আম বিদেশে রপ্তানিযোগ্য ও শতভাগ নিরাপদ। কিন্তু অনেক সময় বাজারে থাকা মানহীন ব্যাগের কারণে তা সম্ভব হয় না। আমের ওজন ১০০ গ্রাম হলেই আমে ব্যাগ পরানো হয়। এতে কৃষক অন্তত ১০ বার কীটনাশক প্রয়োগের হাত থেকে রক্ষা পান।
এ ছাড়া ব্যাগিং করা আম আকর্ষণীয়, দাগহীন ও পুরোপুরি কীটনাশকমুক্ত হয়। তাই আমচাষি, ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক ও ভোক্তার স্বার্থে ফ্রুট ব্যাগিংকে কৃষি পণ্য ঘোষণা করার দাবি জানান এই রপ্তানিকারক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব আম গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সালেহ মোহাম্মদ ইউসুফ আলী জানান, আমের ওজন ৬০ থেকে ১০০ গ্রাম হলে ফ্রুট ব্যাগ করার উপযুক্ত সময়। এতে ব্যাগিং করা আমটি অধিক পরিমাণে হলুদ রং ধারণ করে। তবে আম ফ্রেশ রাখতে চাইলে ৫০ গ্রাম ওজনের সময় ফ্রুট ব্যাগিং করতে হবে। কৃষক ভাইয়েরা সাধারণ রোগবালাই-ছত্রাক দমন করতে ১২ থেকে ১৫ কীটনাশক-ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেন। কিন্তু ফ্রুট ব্যাগিং করায় কিছুই ব্যবহার করতে হবে না, খরচও অনেক কমে যাবে। এমনকি আমগুলো পাকার পর পেড়ে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক ছাড়াই সংরক্ষণ করা যাবে ৯ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত।
তিনি আরও জানান, আম পরিপক্ব হওয়ার আগে-পরে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয়। এতে আমের গায়ে ছত্রাক দেখা দেয়। ফ্রুট ব্যাগিং করলে তা হওয়ার সুযোগ নেই। বিশেষ ধরনের কাগজের এই ব্যাগে দুটি আস্তরণ রয়েছে। বাইরের আস্তরণটি বাদামি রঙের, আর ভেতরেরটি কালো রঙের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, গত বছর জেলায় ৮ কোটি আমে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়। এ বছর তা বেড়ে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালে জেলায় সাড়ে ৭ কোটি আমে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়। ফ্রুট ব্যাগিংয়ের ফলে আমের বাহ্যিক রং খুব আকর্ষণীয় হয়। এতে ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়। এ ছাড়া শতভাগ নিরাপদ আম উৎপাদন নিশ্চিত হয়।
আমচাষিদের অভিযোগ, আমচাষিদের চাহিদাকে পুঁজি করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ায়। তবে এ বছর ফলন কম হওয়ায় ও সরবরাহ বেশি থাকায় দাম বাড়েনি। জেলার বেশির ভাগ আমচাষি অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত হওয়ায় তারা মানসম্মত ফ্রুট ব্যাগ চেনেন না। সেই সুযোগে মানহীন, অকার্যকর ফ্রুট ব্যাগ বাজারজাত করে এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা। তাই ফ্রুট ব্যাগিংয়ের বাজার মনিটরিং বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন আমচাষিরা।
উল্লেখ্য, এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষাবাদ হয়েছে। প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ লাখ গাছে চলতি মৌসুমে কৃষি বিভাগ জেলায় আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৩ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর জেলায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে আড়াই লাখ মেট্রিক টন এবং তার আগের বছর ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়েছে। সূত্র : ঢাকা পোস্ট
কৃষকদের কাছ থেকে অনেকটা ফ্রিতে ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে আকাশছোঁয়া দামে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।