আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ২০০৮ সালে এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার কথা শুনে বেশ ভেঙে পড়েছিলেন মার্ক ফ্রাঙ্কে নামে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলের এক ব্যক্তি। এর তিন বছর পর তিনি লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কথা জানতে পারেন এবং ফের ভেঙে পড়েন।
নর্থ রাইন ওয়েস্টফালিয়ার জার্মান অঞ্চলের নিজ বাড়িতে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেন ৫৪ বছর বয়সী ফ্রাঙ্কে। যখন তিনি জানতে পারেন, তিনি এইচআইভি আক্রান্ত, তখন তার মনে হয়েছিল, এটি তার পৃথিবীকে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে।
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, আমি সবসময় সুরক্ষা নিতাম। কিন্তু দৃশ্যত এক সময় আমি তা করিনি এবং এটি আমাকে পেয়ে বসে।
সৌভাগ্যক্রমে, এইচআইভি মৃত্যুদণ্ডের মতো কোনো শাস্তি নয়। চিকিৎসায় কয়েক দশকের অগ্রগতির পর, অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) নেওয়া রোগীদের আয়ু একই রকমের হয়, যাদের সংক্রমণ নেই।
ফ্রাঙ্কের বয়স যখন ৪২ বছর, তিনি অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন। তিনি ভাবেন, তার হয়তো নিউমোনিয়া হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তীব্র মাইয়েলয়েড লিউকোমিয়া ধরা পড়ে।
২০১১ সালে হাসপাতালে থাকার সময় তার জীবনে একটি পরিবর্তন আসে। শুধু যে তার লিউকোমিয়া হয়েছে এজন্য নয়, তার সঙ্গে দেখা হয়, তার ভবিষ্যৎ সঙ্গীর সঙ্গে, যিনি ডুসেলডর্ফের একজন স্কুল শিক্ষক, তার নাম ইনগো।
ফ্রাঙ্কে বলেন, আমরা অনলাইনে গল্প করতাম, পরে সে সাক্ষাৎ করতে আসে। এইচআইভির বিষয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না। আমার রক্তে সমস্যা নিয়েও তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সে আমার অসুস্থতা নিয়েও কিছু মনে করত না। মানুষ হিসেবেই সে আমার যত্নাদি করত।
তিনি বলেন, ইনগো যখন আসত, তখন আমাকে কিছুটা সুস্থ দেখাত। চিকিৎসকেরা বলতেন, এইচআইভি ও লিউকোমিয়ার জন্য কেমোথেরাপির জন্য তোমার তো ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু আমি ভীত ছিলাম না। আমি জানতাম, আমি তার সঙ্গে থাকতে চাই।
কেমোথেরাপির মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর ফ্রাঙ্কে কিছুটা সুস্থ হন। কিন্তু এক বছর পর ২০১২ সালের আগস্টে তার অবস্থার অবনতি ঘটে। দেহে লিউকোমিয়া বেশি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এতে চিকিৎসার দ্বার খুব অল্পই খোলা থাকে। বিকল্প থাকে স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট। এটি একটি জটিল পদ্ধতি, যা শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট ধরনের মারাত্মক ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য সুপারিশ করা হয়, যেমন লিউকোমিয়া- যা কেমোথেরাপিতে সাড়া দেয় না।
চিকিত্সকেরা ফ্রাঙ্কের চিকিত্সার চেষ্টা করতে আগ্রহী ছিলেন। তারা জানতেন, সিসিআর৫-ডেল্টা মিউটেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট এইচআইভি রোগীদের নিরাময় করেছিল। তারা দেখতে চেয়েছিলেন, এই ক্ষেত্রে কাজ করে কি না।
টিমোথি রে ব্রাউন, যিনি বার্লিনের রোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনি এই পদ্ধতি ব্যবহারে এইচআইভি থেকে নিরাময় হওয়া প্রথম ব্যক্তি ছিলেন। ২০০৮ সালে তার নিরাময়ের বিষয়টি ঘোষণা করা হয়। এর পর লন্ডনের এক রোগীও সুস্থ হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে তার আরোগ্যের খবর জানানো হয়। আরও দুজনকে সম্ভাব্য সুস্থ বলে বিবেচনা করা হয়।
সিসিআর৫-ডেল্টা মিউটেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা মূলত এইচআইভি থেকে অনাক্রম্য, কারণ শরীরে বাস করার জন্য ভাইরাসকে সিসিআর৫ রিসেপ্টরের সঙ্গে ডক করতে হয়। রিসেপ্টর ছাড়া ভাইরাস বাঁচতে পারে না।
চিকিৎসকেরা ফ্রাঙ্কের জন্য একজন দাতা খুঁজছিলেন। ভাগ্যক্রমে পশ্চিম জার্মানিরই এমন একজনকে পাওয়া যায়। সাবেক ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট আনজা প্রাউস। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভ্যালেন্টাইন ডে-তে প্রাউসের বোনমেরু স্থানান্তর করা হয়।
ফ্রাঙ্কের মতো লিউকেমিয়া রোগীদের জন্য স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট এভাবে কাজ করে: প্রথমত, নিবিড় কেমোথেরাপি মূলত রোগীর পুরানো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে মুছে ফেলে। তারপর চিকিৎসকেরা স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্টের সুবিধা দেন, দাতার কোষগুলো রোগীর রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করান। সবকিছু ঠিক থাকলে, এই কোষগুলো রোগীর অস্থিমজ্জা খুঁজে পায় এবং নতুন, পরিবর্তিত রক্তকণিকা তৈরি করতে শুরু করে।
চিকিৎসকেরা বলেন, এটি একটি উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি, যা ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মৃত্যুতেই শেষ হয়। এই চিকিত্সা শুধুমাত্র ফ্রাঙ্কের মতো রোগীদের জন্য নৈতিকভাবে দেওয়া যেতে পারে, যাদের বেঁচে থাকার জন্য স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন, ক্যান্সারমুক্ত এইচআইভি রোগীরা এর যোগ্য নয়।
উন্নত বিশ্বে অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি আপাতদৃষ্টিতে সর্বব্যাপী, যা প্রতিদিন গ্রহণ করলে, একজন ব্যক্তির এইচআইভি কমবেশি অকার্যকর করে দিতে পারে- অবশ্য কেউ ভাবতে পারেন যে, এই মুহূর্তে এইচআইভি নিরাময় করা মূল্যবান কি না।
গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী, এইচআইভি আক্রান্ত ২৫ শতাংশ লোক এআরটি চিকিৎসা নেয় না, কারণ তাদের সুযোগ নেই। এর মধ্যে অনেকেই অন্তর্ভুক্ত নয়, যারা তাদের ওষুধ খেতে ভুলে যান, যা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
স্টেমসেল ট্রান্সপ্ল্যান্টের পর ফ্রাঙ্কে দাতা প্রাউসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের মধ্যে যোগাযোগ হয় প্রাউসের কাছ থেকে পাঠানো একটি চিঠির মাধ্যমে। চিকিৎসকেরা তাকে জানিয়েছিলেন, ফ্রাঙ্কের সবকিছু ভালো চলছে।
২০১৮ সালে ফ্রাঙ্কে এইচআইভির জন্য এআরটি বন্ধ করেন। প্রতি সপ্তাহে তার দুইবার এই ভাইরাসের পরীক্ষা করতে হতো। এখনো তার পরীক্ষা চলছে, তবে প্রতি দুই মাসে একবার।
ফ্রাঙ্কে বলেন, আমার চিকিৎসক ডা. জেনসেনকে লোকজন সুস্থতাদানকারী বলে থাকেন। তবে তিনি সুস্থতা শব্দটি নিয়ে এখনো বেশ সতর্ক। যখন তিনি ন্যাচার মেডিসিনে একটি প্রবন্ধ লিখলেন যে, কীভাবে আমি এইচআইভি থেকে সুস্থ হয়ে উঠলাম, তখন আমি সব প্রমাণ পেয়ে গেলাম যা আমার প্রয়োজন ছিল।
সূত্র: ডয়চে ভেলে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।