আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতের ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি)’র দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইয়ের পাঠ্যসূচি থেকে মুছে ফেলা হয়েছে মুঘল আমলের ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের নাম।
এনসিইআরটি’র দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইয়ে কিছু সংশোধন হচ্ছে বলে আগেই খবর ছিল। কিন্তু কী সংশোধন হচ্ছে, কতটা সংশোধন হচ্ছে, তা আগে জানা যায়নি।
নতুন সংস্করণ সামনে আসার পরই অযোধ্যার ইতিহাস সংশোধন করা হয়েছে বলে জানা গেল। আগে যেখানে চারটি পাতায় অযোধ্যার ইতিহাস লিপিবদ্ধ ছিল, বর্তমানে সেটিকে দুই পাতায় এনে ফেলেছে এনসিইআরটি। এনসিইআরটির পাঠ্যক্রম মেনে চলে সিবিএসই বোর্ড। আইসিএসই এবং আইএসই বোর্ডও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে। স্বাভাবিকভাবে এমন ঘটনায় দেশব্যাপী শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক।
জানা গেছে, গত সপ্তাহে বাজারে আসা এনসিইআরটি’র দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইয়ের নতুন সংস্করণে মাত্র দুই পৃষ্ঠার মধ্যে যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে তাতে কোথাও বাবরি মসজিদের উল্লেখ নেই। বাবরি মসজিদকে বইতে ‘তিন গম্বুজ সম্বলিত নির্মাণ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, গুজরাটের সোমনাথ থেকে অযোধ্যার উদ্দেশে যে রথযাত্রা বের করেছিল বিজেপি, তার কোনো উল্লেখ নেই বইয়ে। উল্লেখ নেই করসেবকদের তাণ্ডবের। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে তাও সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে সেই সময় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়া, কিছুই আর নেই বইয়ে।
আগের এনসিইআরটি’র রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছিল বাবরি মসজিদকে ১৬ শতকে নির্মিত হয়েছে। বইয়ে লেখা ছিল মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি সেটির নির্মাণ করেছিলেন। বইয়ের নতুন সংস্করণে বাবরি মসজিদের নামই উল্লেখ করা হয়নি এক জায়গাতেও। বরং লেখা হয়েছে, ১৫২৮ সালে শ্রী রামের জন্মস্থানে তিন গম্বুজ সম্বলিত একটি নির্মাণ গড়ে তোলা হয়েছিল, যেখানে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন প্রতীকচিহ্ন দৃশ্যমান ছিল। কাঠামোর ভিতরে এবং বাইরে হিন্দু সৌধের ধ্বংসাবশেষ দেখা গিয়েছে। বইয়ের আগের সংস্করণের বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং সংঘর্ষের উল্লেখ ছিল। তবে নতুন সংস্করণে লেখা হয়েছে, ‘অযোধ্যা নিয়ে বিজেপির আফসোসের অন্ত ছিল না।’
পুরনো সংস্করণে লেখা ছিল, ফৈজাবাদ আদালতের নির্দেশে ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেয়ার পর দুই পক্ষের মধ্যে গোলমাল দেখা দেয়। সোমনাথ থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত রথযাত্রা, সাম্প্রদায়িক অশান্তি, করসেবকদের উন্মাদনা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং দাঙ্গার উল্লেখ ছিল আগের সংস্করণে।
নতুন সংস্করণে লেখা হয়েছে, ‘অযোধ্যা নিয়ে আফসোসের অন্ত ছিল না বিজেপির।’ ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে নতুন করে তর্ক-বিতর্কের প্রয়োজন রয়েছে বলে অযোধ্যা থেকেই ধারণা জন্মায় বলেও উল্লেখ রয়েছে বইয়ে।
নতুন সংস্করণে আরো লেখা হয়েছে, ‘শ্রী রামের জন্মভূমিতে মন্দির ভেঙে তিন গম্বুজ সম্বলিত নির্মাণটি দাঁড় করানো হয় বলে বিশ্বাস জন্মায়। মন্দিরের শিলান্যাস হওয়ার পরও নির্মাণের কাজ এগোয়নি। ফলে হিন্দুদের মনে ধারণা জন্মায় যে রামজন্মভূমি নিয়ে তাদের আবেগকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। অন্য দিকে, মুসলিমরা গোটা কাঠামোর উপর দখলদারি চেয়ে দাবি জানায়। সেই নিয়ে দুই তরফে উত্তেজনা বাড়ে। আইনি টানাপোড়েন শুরু হয়। দীর্ঘদিনের এই বিবাদের নিষ্পত্তি চেয়েছিল দুই পক্ষই। ১৯৯২ সালে কাঠামোটি ধ্বংসের পর সমালোচকদের একাংশের মনে হয়েছিল, ভারতীয় গণতন্ত্রের নৈতিকতাই ঝুঁকির সম্মুখীন’।
২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা বিবাদ নিয়ে যে রায় তার উল্লেখ রয়েছে নতুন সংস্করণে লেখা হয়েছে। শীর্ষ আদালতের রায়ের অংশটির নাম রাখা হয়েছে ‘From Legal Proceedings to Amicable Acceptance’। ওই অংশে লেখা রয়েছে, ‘বহুধর্ম এবং বহু সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক সমাজে এই ধরনের বিবাদের ক্ষেত্রে সাধারণত আইনি পথেই সমাধান বেরোয়। আদালত যেভাবে বিতর্কিত জায়গাটি রাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্রের হাতে তুলে দেয় এবং সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে মসজিদ নির্মাণের জন্য অন্যত্র জায়গা বরাদ্দ করার নির্দেশ দেয়, তাতে ভারতীয় সংবিধানের সম্মানরক্ষা হয়েছে। আর এই সিদ্ধান্ত সমাজের অধিকাংশ মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছেন। স্পর্শকাতর একটি বিষয়কে কী ভাবে দু’পক্ষের সম্মতিক্রমে গণতান্ত্রিকভাবে সমাধান করা যায়, তার ধ্রুপদী উদাহরণ হল অযোধ্যার রায়। ঐতিহাসিক রেকর্ড এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতেই আদালত রায় দেয়’ বলে দাবি করা হয়েছে বইয়ের নতুন সংস্করণে। যদিও আদালত জানিয়েছিল, মন্দির ভেঙে মসজিদ হয়েছে বলে কোনো যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এনসিইআরটি’র বইয়ের আগের সংস্করণে খবরের কাগজের প্রতিবেদনের ছবি ছিল, যাতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের উল্লেখ ছিল। ‘অযোধ্যা বিজেপির সবচেয়ে বড় ভুল’ বলে অটলবিহারি বাজপেয়ীর মন্তব্যেরও উল্লেখ ছিল। সেগুলোর কিছুই আর নেই নতুন সংস্করণে।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কল্যাণ সিংহবা। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য ১৯৯২ সালে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহের সরকারকে আদালতের ভর্ৎসনার কথা লেখা ছিল, তা বাদ দেয়া হয়েছে। ১৯৯৪ সালে কল্যাণ সিংহকে দোষী সাব্যস্ত করে সুপ্রিম কোর্ট, বাদ দেয়া হয়েছে সেই কথাও।
প্রসঙ্গত, ভেঙে ফেলা বাবরি মসজিদের স্থানে বর্তমানে রাম মন্দির নির্মিত হয়েছে। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে মন্দিরটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।
সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।