বিশ্বজিৎ পাল বাবু : ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন যে গলায় যদি ফাঁসও লাগানো হয় তাহলে দম থাকা পর্যন্ত জমি কিনবেন, সম্পদ বাড়াবেন। এভাবেই রিপন মিয়া এখন দেড় শ বিঘা জমির মালিক। তবে তাঁর এই ‘জমি কেনা’ মানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ‘গ্রাস’ করা। এতে কেউ বাদ সাধলেই নেমে আসে খড়্গ।
এলাকায় তিনি ‘রিপন সাব’ হিসেবে পরিচিত। ঢাকায় থাকলেও তাঁর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে, কাইতলা উত্তর ইউনিয়নের নারুই (ব্রাহ্মণহাতা) গ্রামে। দামি গাড়িতে চড়ে এলাকায় এসে শুক্র ও শনিবার থেকে বিচারসহ অন্যান্য কাজ সারেন।
জমি নিয়ে বিরোধে রিপন মিয়ার সর্বশেষ অত্যাচারের শিকার হয়েছেন আমিরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি।
এ ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট দেন নবীনগরের বাসিন্দা ও হেফাজতে ইসলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মেহেদী হাসান। মোবাইল ফোনে কথা হলে মেহেদী হাসান বলেন, ‘রিপন মিয়া ধনাঢ্য ব্যক্তি। তাঁর জমি কেনার শখ থাকলে কিনতে থাকুন। কিন্তু মানুষের ওপর অত্যাচার করে কেন?’
রাধিকা-নবীনগর সড়ক হয়ে ৪০ টাকা ভাড়ায় নারুই অটোরিকশাস্ট্যান্ড। সেখান থেকে রিপন মিয়ার সাম্রাজ্যে হেঁটে যেতে সময় লাগে ২৫ মিনিটের মতো। নদীর পার ঘেঁষে বিশাল এলাকাজুড়ে সেই সাম্রাজ্য। প্রবেশপথের ডানেই নদীর পার ঘেঁষে বালু ফেলে উঁচু করা হয়েছে। বাঁ পাশে নানা জাতের ফলের বাগান। বহুদূর বিস্তৃত সীমানাদেয়াল।
ভেতরে তিনতলা ভবন, শেষ প্রান্তে একটি দিঘি।
রিপন মিয়ার অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দিয়েছেন নারুই গ্রামের বৃদ্ধ প্রকাশ দাস বুটাই। অভিযোগটির অনুলিপি বিভিন্ন দপ্তরেও দেওয়া হয়। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, বুটাইয়ের চার কানি জমি কিনতে চান রিপন মিয়া। তবে জমির দাম অনেক কম বলায় ২০২২ সালের আগস্টে বুটাই জমি বিক্রি করে দেন জাকির হোসেনের কাছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে রিপন মিয়া ডিসেম্বর মাসে বুটাইকে জমি বিক্রির স্ট্যাম্প ও চেক নিয়ে তাঁর বাড়িতে আসতে বলেন। বুটাই সেখানে গেলে রিপন স্ট্যাম্প ও চেক রেখে দেন, খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরও করিয়ে রাখেন।
পরে জাকির হোসেন ওই জমিতে চাষ করতে গেলে বাধা দেয় রিপনের লোকজন। বাধ্য হয়ে জাকির ওই জমি ছেড়ে দেন। এ নিয়ে বুটাই ও জাকিরের বিরুদ্ধে সালিস বসিয়ে বুটাইকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জমিতে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিক আবু হোসেন, সাজিদ ভূঁইয়া, কামরুল ইসলাম ও কাজী কামালকে গলায় গামছা দিয়ে মাফ চাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সালিসে থাকা কামরুল ও সাজিদ সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে যান। কামাল ও আবুল ক্ষমা চাইতে না আসায় তাঁদের আউলিয়া বিলে আটকে মারধর করা হয়।
ভাতিজার জমি রিপন মিয়া জোর করে নিতে চাইলে প্রতিবাদ করেছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য অলিউল্লাহ মুন্সী। এখন তিনিই ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মোবাইল ফোনে অলিউল্লাহ বলেন, ‘রিপন মিয়া ভাতিজা আমিরুলের ৭৯ শতক জমির ধান জোর করে কেটে নিতে চায়। ৯৯৯-এ ফোন করে ওই যাত্রায় রক্ষা পায় আমীরুল। পরে এ নিয়ে রিপনের আদালতে আমাকে ৪৬ লাখ ও আমিরুলকে ৩৫ লাখ টাকা জরিমানার আদেশ দেওয়া হয়। জরিমানা না দেওয়ায় আমাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দেওয়া হয়।’
দরিদ্র সোহেল মিয়ার মাত্র পাঁচ শতক জমিতেও নজর পড়ে রিপন মিয়ার। জায়গাটি দিতে গড়িমসি করায় তাঁকে ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা না দেওয়ায় তাঁর ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত শশুরবাড়ি কুমিল্লায় চলে যান সোহেল। পরে সোহেলের বাবা জরিমানার ৯০ হাজার টাকা দিলেও ওই পাঁচ শতক জমি ঠিকই দখলে নিয়ে নেন রিপন মিয়া।
দুই এলাকার বিরোধেরও সুযোগ নেন রিপন মিয়া। প্রায় ৬০ একরের বেশি জমি নিয়ে নারুই ও নোয়াগাঁও গ্রামের মানুষের বিরোধ শত বছর আগে থেকেই। দুই এলাকার মানুষকে নিয়ে বসে রিপন মিয়া সিদ্ধান্ত দেন যে নোয়াগাঁও গ্রামের মানুষ ৬০ শতাংশ ও নারুই গ্রামের মানুষ ৪০ শতাংশ জায়গা পাবে। তবে রিপন মিয়াই এখন ওই জায়গা ভোগদখল করে আছেন।
নবীনগরের এক শীর্ষ জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘রিপন মিয়া আগে গ্রামে সালিস করতেন। আমি দু-একটি সালিসে গিয়েছি। তিনি কারো ওপর অত্যাচার করেন সেটা আমার জানা নেই। তবে অনেক সময় দেখা গেছে, এলাকার লোকজন রিপন মিয়ার কাছে মৌখিকভাবে জমি বিক্রি করে রেখেছে। হয়তো দু-চার বছর পর টাকা নেওয়ার সময় জায়গার দাম তখন বেশি। এ অবস্থায় বিক্রেতা পুরনো কথা থেকে সরে গিয়ে নতুন দাম হাঁকান।’
রিপন মিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করে জেলা প্রশাসন। গত বছরের ৬ জুলাই তদন্ত করতে আসেন ওই সময়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও বর্তমানে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমীন। তিনি স্থানীয় লোকজন, প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন। ভিডিও বক্তব্য নেন রিপন মিয়ার।
এ বিষয়ে রুহুল আমীন বলেন, ‘রিপন মিয়ার বিরুদ্ধে নদী দখল এবং অন্যায়ভাবে সালিস করার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এসব বিষয় তুলে ধরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।’
অভিযোগের বিষয়ে মোবাইল ফোনে রিপন মিয়া বলেন, ‘ঢাকার জমি বিক্রি করে গ্রামে জমি কিনতাম। এ ছাড়া আমার গার্মেন্টস ব্যবসার টাকায় জমি কিনতাম। ওই জমিগুলো থেকে নানাভাবে আমার আয় আসছে। সব মিলিয়ে এখন আমার দেড় শ বিঘার মতো জমি।’
আমিরুলের ওপর হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মূলত জুয়া খেলা নিয়ে মারামারিতে আমিরুল আহত হয়। আর অলিউল্লাহ তো আমারও চাচা। দেখলে সালাম দিই। আমার কারণে কেন তিনি বাড়িছাড়া, সেটা বুঝতে পারছি না।’
প্রশাসনের তদন্তেও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া প্রসঙ্গে রিপন মিয়া বলেন, ‘আমার জায়গা থেকে নদী আরো ৯ ফুট দূরে। প্রশাসনের লোকজনকে বলেছি, যদি মেপে দেখিয়ে দেয় তাহলে আমি মাটি সরিয়ে নেব। আমি কোনো সালিসও করি না। এসব অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে যত জায়গা আছে আমি সব লিখে দিয়ে চলে আসব।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।