জুমবাংলা ডেস্ক: জি-৩ রুই মাছ নিয়ে স্বপ্ন বুনছে যশোর। ‘জেনেটিক্যালি ইম্প্রুভ’ রুই মাছের এ জাতটির উৎপাদন সাধারণ রুই মাছের তুলনায় ৩৭ শতাংশ বেশি। ওয়ার্ল্ড ফিশ উদ্ভাবিত এই জাতের রেণুপোনা উৎপাদন করছে যশোরের ছয়টি হ্যাচারি। এ হ্যাচারি থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় এই পোনা সরবরাহ করা হচ্ছে।
চাষিপর্যায়ে এ মাছ ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হলে আগামী তিন বছরে পুকুরে রুই মাছের উৎপাদন লক্ষাধিক টন বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এজন্য জি-৩ রুইয়ের রেণুপোনা উৎপাদন ও সরবরাহ করে যশোরের হ্যাচারিগুলো মৎস্য সেক্টরে অনন্য ভূমিকা রাখার স্বপ্ন দেখছে।
যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফিরোজ আহম্মেদ জানান, রুই মাছের ‘জেনেটিক্যালি ইম্প্রুভ’ করে এ জাতটি উদ্ভাবন করেছে ওয়ার্ল্ডফিশ। চাষিদের কাছ থেকে জেনেছেন, এর উৎপাদনের হার ৩৫ শতাংশ বেশি। একই পরিবেশে ও একই খাবারে এই মাছটি চাষ করা সম্ভব এবং এর কোনো নেগেটিভ দিক নেই। গুণগতমান ধরে রেখে এই মাছ চাষ ছড়িয়ে দেওয়া গেলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, যশোরের ছয়টি হ্যাচারি এই মাছের রেণুপোনা উৎপাদন করছে। সারা দেশে রেণুপোনা ছড়িয়ে দিতে হ্যাচারিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে যদি তারা সততা ও আন্তরিকতার সাথে গুণগতমান ধরে রেখে রেণুপোনা সরবরাহ করতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ফিশ’ বাংলাদেশে ২০১২ সালে রুই মাছের একটি উন্নত জাত উদ্ভাবনের উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০১২-১৩ সালে হালদা, পদ্মা ও যমুনা নদী থেকে রেণুপোনা সংগ্রহ করা হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে এই তিন নদীর মাছের মধ্যে থেকে সর্বোৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় করে জাত উন্নয়ন (জেনেটিক্যালি ইম্প্রুভ) করা হয়। এভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের পর সর্বশেষ তৃতীয় প্রজন্ম বা জি-৩ জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ফিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ ও ২০২১ সালে ওয়ার্ল্ড ফিশ কৌলিতাত্ত্বিকভাবে উন্নত তৃতীয় প্রজন্ম বা জি-৩ রুই মাছের রেণু স্বল্প পরিসরে কিছু সংখ্যক হ্যাচারিতে অবমুক্ত করে। পরবর্তীতে এসব হ্যাচারি মাছগুলোকে বড় করে তোলে এবং নার্সারি ও খামারিদের কাছে বিক্রির জন্য বীজ উৎপাদন শুরু করে।
হ্যাচারিতে অবমুক্তের পাশাপাশি ওয়ার্ল্ড ফিশ ২০২১ সালের মে থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত যশোর, নাটোর ও রাজশাহী জেলার ১৯টি আধা-বাণিজ্যিক খামারে জি-৩ রুইয়ের পরীক্ষামূলক চাষ সম্পন্ন করে। পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল, হালদা, পদ্মা ও যমুনা নদী হতে উৎপন্ন অনুন্নত সাধারণ রুই এবং হ্যাচারি থেকে সংগ্রহ করা বহুল সমাদৃত একটি বাণিজ্যিক রুই এর সাথে জি-৩ রুইয়ের তুলনামূলক বৃদ্ধির হার যাচাই করা। পরীক্ষা শেষে জি-৩ রুই ১৯টি খামারের প্রতিটি খামারেই বৃদ্ধির দিক থেকে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সব খামারের গড় হিসাবে নদী হতে উৎপন্ন অনুন্নত রুই থেকে ৩৭ ভাগ বেশি বৃদ্ধি পায়।
ওয়ার্ল্ড ফিশের ফিশ ব্রিডিং অ্যান্ড রিসার্চ প্লাটফর্ম ম্যানেজার মো. মাসুদ আক্তার জানান, জি-৩ রুই মাছের উৎপাদন সাধারণ রুইয়ের তুলনায় ৩৭ শতাংশ বেশি। এই মাছের নেতিবাচক কোনো দিক নেই। তাই সারা দেশে এই মাছকে ছড়িয়ে দিতে হবে। দেশে ২০২০-২১ সালে শুধু পুকুরে রুই মাছ উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৯৪ হাজার ৮৩৭ মেট্রিক টন। রুইয়ের পরিবর্তে জি-৩ রুই ছড়িয়ে দিতে পারলে আগামী তিন বছরে উৎপাদন আরও ১ লাখ ৯ হাজার ৮৯ মেট্রিক টন বৃদ্ধি করা সম্ভব; যা বাংলাদেশ সরকারের ২০৪১ সালের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২০-২১ সালে এই জাতটি দেশের নির্বাচিত ১৯টি হ্যাচারিতে সরবরাহ করা হয় ব্রুড মাছ উৎপাদনের জন্য। এর মধ্যে যশোরের ৬টি হ্যাচারি রয়েছে। হ্যাচারিগুলো হলো, মা ফাতিমা ফিস হ্যাচারি, মুক্তেশ্বরী ফিস হ্যাচারি, মাতৃ ফিস হ্যাচারি, রূপালী ফিস হ্যাচারি, মধুমতি ফিস হ্যাচারি ও ন্যাশনাল ফিস হ্যাচারি। গত বছর প্রথমবারের মতো যশোরের এ হ্যাচারিগুলো জি-৩ রুইয়ের ২৭৬ কেজি রেণুপোনা উৎপাদন করে। এবছরও ইতোমধ্যে এই হ্যাচারিগুলো থেকে প্রায় ৮শ কেজি জি-৩ রুই রেণুপোনা উৎপাদন করে চাষিপর্যায়ে সরবরাহ করেছে। জি-৩ রুইয়ের রেণুপোনা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় যশোরের এই ছয় হ্যাচারি মালিককে সম্মাননাও প্রদান করেছে ওয়ার্ল্ডফিশ। চাহিদাসাপেক্ষে এই বছর এই জেলার হ্যাচারিগুলোর ২ থেকে ৩ মেট্রিকটন রেণুপোনা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে এজন্য চাষিদের এ মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে বলে হ্যাচারি মালিকরা জানিয়েছেন।
যশোর জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ও মা ফাতিমা ফিস হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী ফিরোজ খান বলেন, বাংলাদেশে মাছের ঘাটতি পূরণে জি-৩ রুই অভাবনীয় ভূমিকা রাখবে। এজন্য ওয়ার্ল্ডফিশের মাধ্যমে যশোরের ৬টি হ্যাচারি এই মাছের রেণুপোনা উৎপাদন করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই রেণুপোনা উৎপাদনে যশোরের হ্যাচারিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সারাদেশে এই মাছের চাষ ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হলে রেণুপোনা উৎপাদনে নেতৃত্ব দেবে যশোরের হ্যাচারিগুলো।
যশোর জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মাতৃ ফিস হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী জাহিদুর রহমান গোলদার বলেন, জি-৩ রুইয়ের রেণুপোনা উৎপাদন করে সরবরাহ করছেন। এর উৎপাদনের হার তুলনামূলক বেশি হওয়ায় রেণুপোনার চাহিদা বাড়ছে। এর চাষ ছড়িয়ে দিতে পারলে দেশের মাছ উৎপাদনের ঘাটতি যেমন পূরণ হবে; তেমনি বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
এ বছরই প্রথম বারের মতো জি-৩ রুইয়ের চাষ শুরু করেছেন সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকার মৎস্যচাষি আরশাদ আলী সরদার। তিনি বলেন, হ্যাচারি মালিকদের কাছে শুনেছেন জি-৩ রুই মাছের বৃদ্ধি অনেক বেশি। এ কারণে এবছরই তিনি পরীক্ষামূলক জি-৩ রুই মাছের পোনা ছেড়েছেন। এক মাসে বেশ ভালোই বাড়ছে। আশা করছি ভালো ফল পাওয়া যাবে। কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন হলে এ চাষের পরিধি আরও বাড়াবেন বলে জানালেন তিনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।