জুমবাংলা ডেস্ক : রাসেলস ভাইপার আতঙ্কে ভুগছে সারাদেশের মানুষ। এ প্রজাতির সাপ মারতে পারলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। দেশে সচরাচর এই সাপের দেখা না মিললেও বর্তমানে পদ্মার পাড় সংলগ্ন ও বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকাসহ কিছু জেলায় এ সাপ প্রকাশ্যে আসছে। তবে এ নিয়ে আতঙ্ক না ছড়িয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন প্রাণি বিশেষজ্ঞরা।
রাসেলস ভাইপার সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা বিষধর সাপ। কিন্তু এই সাপ দৌড়ে তাড়া করে না, বাসায় এসে কামড়াবে না। এরা সাধারণত কৃষি জমিতে ইঁদুর, ব্যাঙ, কীট-পতঙ্গ অন্যান্য প্রাণী খেয়ে থাকে। ফলে আতঙ্ক না ছড়িয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালাতে হবে। প্রথমত, চেনানো দরকার সাপটা দেখতে কেমন।
ফিরোজ জামান বলেন, এটার সঙ্গে অজগর ও স্যান্ডবোয়ারের মিল আছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই গায়ের গোল রিংয়ের ভিন্নতা চোখে পড়বে। রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়ার গায়ের গোল চিহ্নগুলো আলাদা। আর অজগরের গোল চিহ্নগুলো জালের মতো, একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো।
সম্প্রতি দেশের ২৭টি জেলায় রাসেলস ভাইপার ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রামের ভেনম রিসার্চ সেন্টার।
বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, ভুটান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, চীন ও মিয়ানমারেও এই ভয়ংকর বিষধর সাপের উপস্থিতি রয়েছে বলে জানিয়েছে ভেনম রিসার্চ সেন্টার। এ সাপ সাধারণত ঘাস, ঝোপ, বন, ম্যানগ্রোভ ও ফসলের খেতে বাস করে।
এ সাপের নাম রাসেলস ভাইপার কেন-
ভারতে কাজ করতে এসেছিলেন স্কটিস সার্জন প্যাট্রিক রাসেল। ১৭৯৬ সালে তিনি এই সাপ সম্পর্কে গবেষণা করেন। পরে তার নাম অনুসারে এই সাপের নামকরণ করা হয় ‘রাসেলস ভাইপার।’ তবে বাংলাদেশে এটি চন্দ্রবোড়া ও উলুবোড়া নামেও পরিচিত।
বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপারের অস্তিত্ব প্রকাশ-
যদিও এটি ২০১৩ সালে আলোচনায় এসেছিল, কিন্তু ১৯৯৫ সালে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে একটি মৃত্যুর রেকর্ড আছে। রাজশাহীর তানোর উপজেলার শিবরামপুর গ্রামে রাসেল ভাইপারের কামড়ে আদিবাসী (শাওতাল) এক নারীর মৃত্যু হয়। তবে স্থানীয় লোকজন ওই সাপটিকে মেরে ফেলে। এ পর্যন্ত রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা জানা না গেলেও বিভিন্ন সূত্র মতে এ সাপের কামড়ে ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বল্প সংখ্যক রাসেল ভাইপার সবসময়ই ছিল। কিন্তু বংশ বিস্তারের মতো পরিবেশ ও পর্যাপ্ত খাদ্য না থাকায় এই সাপের উপস্থিতি তেমন একটা বোঝা যায়নি।
প্রাণি গবেষকদের মতে, একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল ফলানোর কারণে সম্প্রতি এ সাপের বংশবৃদ্ধি ঘটছে।
গবেষকদের মতে, ৯০–এর দশকে সেচ পদ্ধতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা বছরে দুই থেকে তিনটি ফসল ফলানো শুরু করেন এবং জমি কম সময় পরিত্যক্ত থাকতে শুরু করে। সারা বছর ক্ষেতে ফসল থাকায় জমিতে ইঁদুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যা এই সাপের প্রধান খাদ্য। আর ইঁদুর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাপ পর্যাপ্ত খাদ্য পেতে শুরু করে এবং বংশবিস্তারের জন্য যথাযথ পরিবেশ পেতে থাকে।
রাসেলস ভাইপারের বংশবৃদ্ধি-
বেশির ভাগ সাপ ডিম পাড়লেও রাসেল ভাইপার বাচ্চা দেয়। গর্ভধারণ শেষে স্ত্রী রাসেলস ভাইপার সাধারণত ২০ থেকে ৪০টি বাচ্চা দেয়। তবে ৮০টি পর্যন্ত বাচ্চা দেওয়ার রেকর্ডও রয়েছে।
এশিয়াটিক সোসাইটির ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্ষাকালে নদীর পানি বাড়ার ফলে ভারতের নদ-নদী থেকে ভেসেও এই সাপ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। এখন পর্যন্ত পদ্মা অববাহিকায় এই সাপ সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। যেসব জায়গায় এই সাপ পাওয়া গেছে তার অধিকাংশ জায়গাতেই কচুরিপানা রয়েছে, আবার কচুরিপানার মধ্যেও এই সাপ পাওয়া গেছে। কাজেই গবেষকদের ধারণা, কচুরিপানার ওপরে ভেসে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এই সাপ বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছেছে।
কতটা ভয়ংকর রাসেলস ভাইপার-
এই সাপের বিষক্রিয়া মারাত্মক বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা। রাসেলস ভাইপারের দংশনের পরে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। ব্যথার পাশাপাশি আক্রান্ত জায়গা দ্রুত ফুলে যায়। চিকিৎসকেরা বলছেন, দ্রুত চিকিৎসা না করা হলে নিম্ন রক্তচাপ, কিডনি অকার্যকর হওয়াসহ বিভিন্ন ধরণের শারীরিক সমস্যা তৈরি হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে অন্তত ছয় হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রাসেলস ভাইপার গোখরো-কেউটের চেয়েও বিষধর। সাপটির দংশনে রোগীরা চিকিৎসাধীন অবস্থাতেও প্রতি তিনজনে একজন মারা যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে।
চিকিৎসা ব্যবস্থা-
এই সাপের কামড়ানো রোগীকে ‘অ্যান্টিভেনম’ দেওয়া হয়। এই অ্যান্টিভেনম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় এসেনশিয়াল ড্রাগ বা অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকাভুক্ত হলেও বাংলাদেশে তা উৎপাদন হয় না, ভারত থেকে আমদানি করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একেক সাপের প্রকৃতি একেক রকম। তাই স্থানীয় সাপ থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি হলে তা সবচেয়ে কার্যকর হয়। অন্য দেশ থেকে অ্যান্টিভেনম আনলে তা শতভাগ কার্যকর নাও হতে পারে।
রাসেলস ভাইপার কামড়ালে করণীয়-
চিকিৎসকদের মতে, রাসেল ভাইপারের কামড়ে যদি দাঁত বসে যায়, তাহলে ক্ষতস্থানের ওই জায়গাটিসহ ওপর-নিচের খানিকটা জায়গা নিয়ে হালকা করে ব্যান্ডেজ দিয়ে পেঁচিয়ে দিতে হবে। নড়াচড়া করা যাবে না। রোগীকে সাহস দিতে হবে। হাঁটা-চলাচল একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। যাতে রক্ত চলাচলটা একটু কম হয়। এভাবে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।