জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামি শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি সাফাই সাক্ষী (আসামিপক্ষের সাক্ষী) হিসেবে এ মামলায় জবানবন্দি দেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এই প্রথম কোনো আসামির পক্ষে সাফাই সাক্ষী হাজির করা হলো।

সোমবার (৮ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
জবানবন্দিতে আরশাদ বলেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আমি সরকারি আদেশ-নির্দেশ মেনে নিজের কর্তব্য পালন করি। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিদিন শাহবাগ থানার এসআই, এএসআই ও কনস্টেবলদের দায়িত্ব বণ্টন করি। বাইরে থেকে আসা পুলিশের সব ফোর্সকে বিভিন্ন পয়েন্টে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মোতায়েনের ব্যবস্থা করি। শাহবাগসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি পয়েন্টে প্রতিদিন কর্মকর্তা ও ফোর্স সঠিক সময়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি। জুলাই বিপ্লব আন্দোলনের সময় আমি শাহবাগ মোড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে থেকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করি। তৎকালীন সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করি। তাদের আন্দোলনে আমরা সার্বিক সহযোগিতা করেছি। যেন রাজপথে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। শাহবাগ থানা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় আমি ২০-২২ ঘণ্টা দায়িত্বে ছিলাম।
তিনি বলেন, ৩১ জুলাই ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে শাহবাগ মোড়ে সকাল ৯টায় দায়িত্বে নিয়োজিত হই আমি। বেলা ১১টায় ওয়্যারলেসে (আলফা মাইক ২১১) আমাকে হাইকোর্ট মাজার গেটের সামনে আসতে বলেন এডিসি আখতার স্যার। হাইকোর্ট মাজার গেটের সামনে এসে যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, ডিসি রমনা আশরাফ হোসেন, এডিসি আখতার স্যার, এসি ইমরুল স্যার, ওসি মোস্তাজিরুর স্যারসহ সবাইকে উপস্থিত দেখি। আমাদের এখানে এক প্লাটুন ফোর্স অর্থাৎ ২০ জন পুলিশ সদস্যকে ব্রিফ করেন ডিসি (রমনা) আশরাফ হোসেন স্যার। এর মধ্যে এসি ইমরুল স্যারের নেতৃত্বে আরও ২০ জন ফোর্স সেখানে আসে। দুপুর ১২টার দিকে চারদিক থেকে সরকারবিরোধী ও পুলিশের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। কোনোভাবেই আন্দোলনকারীদের হাইকোর্ট গেটের সামনে আসতে দেওয়া যাবে না বলে আমাদের জানান ডিসি স্যার ও যুগ্ম কমিশনার স্যার।
ওই সময় প্রেসক্লাবের দিক থেকে মিছিল করতে করতে হাইকোর্টের মাজার গেটের দিকে আসতে থাকেন ২০০-২৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী। ১০০-১৫০ জনের আরেকটি মিছিল শিক্ষা ভবনের দিক থেকে আসতে থাকে। তখন আমি ও এসি ইমরুল স্যার মিলে ফোর্স নিয়ে বাধা দিলে তারা থেমে যান। কিন্তু প্রেসক্লাবের দিক থেকে আসা মিছিলটি আমাদের বাধা উপেক্ষা করে হাইকোর্টের গেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। একইসঙ্গে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়- ‘ফুটফুটে সুন্দর আসছে’। কয়েকজন মেয়ে আমাকে লক্ষ্য করে মাটির দিকে থুতু নিক্ষেপ করে। এতে আমরা উত্তেজিত হয়ে দুজন আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করি। তারা প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে পরিচয় দেন। পরে বলে খিলগাঁও মডেল কলেজের ছাত্র। আমি বলি মিথ্যা কথা বলছো কেন? তখন সে উত্তেজিত হয়ে জোরে জোরে কথা বলতে থাকলে আমি বাম হাত উঁচিয়ে চুপ থাকতে বলি। এছাড়া তার বেল্ট ধরে নিয়ে গাড়িতে উঠাই। পরে জানতে পারি তার নাম নাহিদ। মাজার গেটের সামনে এলে আরও কিছু আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীরা আমার ইউনিফর্ম ধরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে পেছনের দিকে নিয়ে যান। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের জিজ্ঞাসাবাদে এই সাক্ষী জানান, ভিডিওটি তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘বার্তা বাজার’ থেকে সংগ্রহ করেছেন। তখন বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট মাহাবুব উদ্দিন খোকন এসে অনুরোধ করলে ডিসি স্যারকে বলে ওই ছাত্রসহ আটক দুজনকে ছেড়ে দেন তিনি। তখন বিভিন্ন চিত্রের অংশবিশেষ কেটে এডিট করা একটা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়। ফলে মানসিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন বলে জানান আরশাদ।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলন চরমপর্যায়ে পৌঁছালে কারফিউ জারি করে সরকার। কারফিউতে আমাদের থানায় থাকার নির্দেশ দেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সকাল ৬টার দিকে আমি শাহবাগ মোড়ের একটু সামনের চেকপোস্টে নিয়োজিত হই। বেলা ১১টা পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন করি। তখন সেনাবাহিনী এসে শাহবাগ মোড় থেকে সব পুলিশকে সরে যেতে বললে আমি থানায় চলে আসি। বিষয়টি জানালে আমাকে দ্রুত চানখারপুল রিপোর্ট করতে বলেন এডিসি আখতার স্যার। বেলা সাড়ে ১১টায় প্রথমে শহিদুল্লাহ হল ক্রসিং চেকপোস্টে যাই। সেখান থেকে চানখারপুলে এডিসি আখতার স্যারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু প্রচুর সাউন্ড গ্রেনেড, গুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের কারণে যেতে পারিনি। এর অল্প কিছুক্ষণ পর এডিসি আখতার স্যারের সঙ্গে দেখা করে শাহবাগ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দেই। তখন শহিদুল্লাহ হল ক্রসিং চেকপোস্টের সামনে পুলিশের সঙ্গে অবস্থান করতে বলেন তিনি। দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে ৩০০-৪০০ জন ছাত্র-জনতা স্লোগান দিতে থাকেন। আন্দোলনকারীদের দুজন পরিচিত হওয়ায় আমার কাছে এসে বলে আপনারা চলে যান, সরকার পতন হয়ে গেছে।
সোয়া ১২টার দিকে এডিসি আখতার স্যারকে বিষয়টি জানাই। পরে তার অনুমতিক্রমে আমরা সবাই থানায় চলে যাই। ওই দিন আমি চানখারপুলে কোনো অস্ত্র ব্যবহার করিনি। কাউকে গুলি করিনি। কাউকে খুন বা আহত করিনি। গুলি করার নির্দেশ বা সহযোগিতাও করিনি। আইন অনুযায়ী ১৮ আগস্ট পর্যন্ত শাহবাগ থানায় দায়িত্ব পালন করেছি। পরবর্তী সময়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আমাকে ক্লোজড করা হয়।
জেলের জালে ৭১ কেজির বিশাল বাঘাআইড়, ১ লাখ ৫ হাজার টাকায় বিক্রি
এ সময় তিনি বলেন, আমি যদি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকতাম তাহলে পরবর্তী পাঁচ মাস কর্মস্থলে না থেকে পালিয়ে যেতাম। আমি সিআরপিসি, পিআরবি, পুলিশ আইন, ডিএমপি অধ্যাদেশ অনুযায়ী আমার দায়িত্ব পালন করেছি। ৩১ জুলাই আন্দোলনকারী ছাত্ররা আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা সত্ত্বেও কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ করিনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



