একজন আদর্শ পিতার মতো নবীজি (সা.) উম্মতের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল ছিলেন। তিনি তাঁর উম্মতের কল্যাণে প্রতিনিয়ত দোয়া করতেন, বিশেষত তিনি তাঁর সাহাবিদের জন্য বহু দোয়া করেছেন। তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব তাদের জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল। সাহাবিদের জন্য নবী করিম (সা.)-এর কয়েকটি দোয়ার বিবরণ তুলে ধরা হলো; যেন অভিভাবক ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা অধীনদের জন্যও অনুরূপ দোয়া করতে পারেন।

দোয়া আল্লাহর শিক্ষা
সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ও উম্মতের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) নিয়মিত দোয়া করতেন। তাঁর এই দোয়া ছিল আসমানি শিক্ষারই ফল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করবে। তার দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে।
তুমি তাদের জন্য দোয়া করবে। তোমার দোয়া তো তাদের জন্য প্রশান্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’
(সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০৩)
তাঁর দোয়া কবুল হতো
নবী করিম (সা.) ছিলেন মুস্তাজাবুদ দোয়া। অর্থাৎ তিনি এমন ব্যক্তি ছিলেন, যার দোয়া আল্লাহ কবুল করতেন। পবিত্র কোরআনের আয়াত থেকেও তেমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেন, ‘অচিরেই তোমার প্রভু তোমার প্রতি অনুগ্রহ করবেন। আর তুমি সন্তুষ্ট হবে। (সুরা : দুহা, আয়াত : ৫)
সাধারণভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সব দোয়াই কবুল হতো।
তবে কিছু কিছু দোয়া আল্লাহ কবুল করতেন, এটা বোঝাতে যে নবী (সা.)-ও আল্লাহর ইচ্ছাধিকারের বাইরে নন। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি আমার প্রতিপালকের কাছে তিনটি বিষয় চেয়েছি। আমাকে দুটি দেওয়া হয়েছে এবং একটির ব্যাপারে নিষেধ করা হয়েছে। আমি আমার প্রতিপালকের কাছে কামনা করেছিলাম যেন তিনি আমার উম্মতকে দুর্ভিক্ষের দ্বারা ধ্বংস না করেন। তিনি আমার এই দোয়া কবুল করেছেন। তাঁর কাছে এটাও প্রার্থনা করেছিলাম যে তিনি যেন আমার উম্মতকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস না করেন। তিনি আমার এই দোয়াও কবুল করেছেন। আমি তাঁর কাছে এই মর্মেও দোয়া করেছিলাম, যেন মুসলিম পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়। তিনি আমার এই দোয়া কবুল করেননি। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৮৯০)
সাহাবিদের জন্য নবীজি (সা.)-এর দোয়া
কয়েকজন সাহাবির জন্য করা নবীজি (সা.)-এর দোয়ার বিবরণ তুলে ধরা হলো—
১. আবু হুরায়রা (রা.) : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে এসেছে, তাঁর মা মুশরিক ছিলেন। তিনি তাঁর মাকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানালে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে মন্দ কথা বলেন। এতে আবু হুরায়রা (রা.) মনঃক্ষুণ্ন হয়ে নবীজি (সা.)-এর কাছে যান এবং তাঁর মায়ের হেদায়েতের জন্য দোয়া চান। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর মায়ের হেদায়েতের জন্য দোয়া করেন। তিনি বাড়ি ফিরে দেখেন তাঁর মা ইসলাম গ্রহণের জন্য পূতঃপবিত্র হয়ে প্রস্তুত হয়ে আছেন। তিনি তাঁকে কালেমা পাঠ করান। এই সংবাদ নবী করিম (সা.)-কে দিলে তিনি অত্যন্ত খুশি হন এবং আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা আদায় করেন। অতঃপর তিনি দোয়া করেন আল্লাহ যেন আবু হুরায়রা (রা.) ও তাঁর মাকে মুমিনদের প্রিয়ভাজন করেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৪৯১)
২. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ছিলেন একজন কিশোর সাহাবি। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য অজুর পানি প্রস্তুত করেন। তাঁর এই সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে নবীজি (সা.) দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি তাঁকে দ্বিনের গভীর জ্ঞান দান করুন এবং তাঁকে কোরআনের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪৩; মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৩৯৭)
৩. সায়িব ইবনে ইয়াজিদ (রা.) : জুআইদ ইবনে আবদুর রহমান (রহ.) বলেন, ‘আমি সাবি ইবনে ইয়াজিদ (রা.)-কে ৯৪ বছর বয়সে সুস্থ-সবল ও সুঠাম দেহের অধিকারী দেখেছি। তিনি বললেন, তুমি অবশ্যই জানো যে আমি এখনো নবী (সা.)-এর দোয়ার বরকতেই চোখ ও কান দিয়ে উপকার লাভ করছি। আমার খালা একদিন আমাকে নিয়ে নবী (সা.)-এর কাছে গেলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার ভাগিনা রোগাক্রান্ত। আপনি তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। তখন নবী (সা.) আমার জন্য দোয়া করলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৫৪০)
৪. সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) : রাসুলুল্লাহ (সা.) সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর জন্য দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ! আপনার কাছে দোয়া করলে তা গ্রহণ করুন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৭৫১)
বর্ণিত আছে, সাআদ (রা.)-এর ওপর এক ব্যক্তি অপবাদ দিলেন তিনি তার জন্য বদদোয়া করেন এবং সেই দোয়া কবুলও হয়। (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ২/৩৫০)
৫. আবু কাতাদা আনসারি (রা.) : আবু কাতাদা (রা.) বলেন, জুলকরাদের দিন আল্লাহর রাসুল (সা.) আমার কাছে এসে আমার দিকে তাকালেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! তার চুলে ও ত্বকে বরকত দান করুন। তারপর বললেন, তোমার মুখ উজ্জ্বল হোক। আমি বললাম, আর আপনার মুখমণ্ডলও হে আল্লাহর রাসুল। তিনি বললেন, তুমি কি মাসআদাকে হত্যা করেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে তোমার মুখমণ্ডলে এটা কী? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমার ওপর একটি তীর আঘাত করেছে। তিনি বললেন, কাছে এসো। তাই আমি তাঁর কাছে গেলাম এবং তিনি তাতে থুথু দিলেন। তিনি আর কখনো আমাকে আঘাত করেননি, কাশিও দেননি। (মুসতাদরাক, হাদিস : ৬১৫৯)
৬. ফাতিমা (রা.) : ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) বলেন, আমি নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে বসা ছিলাম। তখন ফাতিমা (রা.) এলেন এবং নবীজি (সা.)-এর বিপরীতে দাঁড়ালেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে ফাতিমা কাছে এসো। তিনি কিছুটা আগালেন। তিনি আবার বললেন, হে ফাতিমা কাছে এসো। তিনি কিছুটা আগালেন। তিনি আবার বললেন, হে ফাতিমা কাছে এসো। তিনি কিছুটা আগালেন; এমনকি তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে এলেন। ইমরান (রা.) বলেন, আমি ফাতিমা (রা.)-এর চেহারায় হলুদাভাব দেখলাম। তিনি ছিলেন রক্তশূন্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ঘাড়ে হাত রাখলেন এবং আসমানের দিকে মাথা তুলে দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! ক্ষুধা নিবারণকারী, প্রয়োজন পূরণকারী ও পরিস্থিতির উন্নয়নকারী—আপনি মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাকে ক্ষুধার্ত রাখবেন না। বর্ণনাকারী বলেন, আমি দেখলাম ফাতিমা (রা.)-এর চেহারা থেকে ক্ষুধার কারণে হওয়া হলুদাভাব দূর হয়ে গেছে এবং রক্তশূন্যতা দূর হয়েছে। (মাজমাউল জাওয়াইদ : ৯/২০৬)
হে আল্লাহ! আপনার নবী উম্মতের জন্য যেসব কল্যাণের দোয়া করেছেন তা আমাদের নসিব করুন। আমিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



