শফিকুল ইসলাম : মুঘল ও ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতির এক সুসমন্বিত রূপ। বিশেষ করে নির্মাণশৈলীতে ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির প্রভাব রয়েছে। চারদিকে উন্মুক্ত সবুজ চত্বরে ঘেরা বৃহৎ প্রাসাদসম ভবন। সহজেই পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দৃষ্টিনন্দন হলুদ গম্বুজগুলো ভবনটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। গম্বুজগুলো ভবনটির নান্দনিকতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সবচেয়ে আকর্ষণীয় এর স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য, নির্মাণ রীতি ও অলংকারশৈলী। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিপরীত দিকে, ব্রিটিশ কাউন্সিলের পাশে অবস্থিত এ ভবনটি শতবর্ষী এক ঐতিহাসিক ছাত্রাবাস। নাম সলিমুল্লাহ মুসলিম হল (এসএম হল)। প্রাচীন এ ছাত্রাবাসটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের তিনটি ছাত্রাবাসের অন্যতম। সামনে প্রশস্ত লন এবং বাগান পরিবেষ্টিত এ ভবনটির রূপ নজরকাড়া। শুধু স্থাপত্যশৈলীতেই নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ঐতিহ্যবাহী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা নবাব খাজা সলিমুল্লাহর নামে নামকরণ করা হয় ছাত্রাবাসটির।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর হলটির নাম আংশিক সংক্ষিপ্ত করে ‘সলিমুল্লাহ হল’ বলে অভিহিত করা হলেও পরবর্তী সময়ে পূর্বের ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’ নামটিই স্থায়ী রূপ পায়। শিক্ষার্থীরা সংক্ষেপে ‘এসএম হল’ বলেন। অবশ্য ছাত্রাবাসটির ডাকনাম সম্পর্কে আরেকটি জনশ্রুতি রয়েছে। অনেকে ‘জামাই হল’ নামেও ডাকত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী মুসলিম ছাত্ররা থাকতেন বলে হলের শিক্ষিত ছাত্রদের মধ্য থেকে পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত পরিবার পাত্র খুঁজতে এখানে আসত।
নকশা ও নির্মাণশৈলী
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল নির্মিত হয় ১২ দশমিক ৯১ একর জমির ওপর। ভবনটি নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন পূর্ত বিভাগের স্থপতি গেইথার। নির্মাণকাজ তদারকি করেন ডি. জে. ব্লুমফিল্ড এবং এএফএলএইচ হ্যারিসন। প্রধান ঠিকাদার ছিলেন মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি। নির্মাণে ব্যয় হয় তৎকালীন সাড়ে ৯ লাখ টাকা। হলে মোট কক্ষ রয়েছে ১৮০টি। এর মধ্যে ১৫২টি ছাত্রদের থাকার জন্য বরাদ্দ। মোট ভবনের আয়তন দেড় লাখ বর্গফুট। দোতলা এ ছাত্রাবাসটি দক্ষিণমুখী। এটি চারটি শাখায় বিভক্ত। মাঝখানে একটি আয়তাকার উঠোন রয়েছে। উঠোনটি উত্তর ও দক্ষিণমুখী হাঁটার রাস্তা দিয়ে বিভক্ত। বারান্দাগুলো ভবনের সম্মুখভাগে। এগুলোর মুখ উঠোনের দিকে। দক্ষিণ শাখার কেন্দ্রে অবস্থিত প্রবেশদ্বারে তিনটি পয়েন্টযুক্ত খিলান রয়েছে। তার পাশে আছে দুটি বর্গাকার টাওয়ার। প্রতিটির মাথায় একটি করে কন্দাকার হলুদ টাইলস করা গম্বুজ। হলের রুম নম্বরেও রয়েছে বৈচিত্র্য। দোতলা ভবনের নিচতলার রুমগুলো বিজোড় সংখ্যার আর ওপরের রুমগুলো জোড়সংখ্যার। নিচতলার রুমের নং যদি হয় ১১, ঠিক তার ওপরের দোতলা রুমের নং ১২। সাধারণত রুমের ক্রমিক নং পাশাপাশি থাকলেও এ ভবনের রুমের ক্রমিক নং আলাদা। হলের চতুর্দিকের বেষ্টনীর মাঝে রয়েছে ফুলের বাগান। আয়তন ৭৫ হাজার বর্গফুট। হলের সামনে দিয়ে প্রবেশের সময় হাতের ডানে দক্ষিণ পাশে দেখা যায় একটি মিনার। মুক্তিযুদ্ধে হলের শহীদদের স্মৃতির নিদর্শনস্বরূপ ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করা হয় এটি। হলুদ রঙের এ মিনারটির উচ্চতা ১৫ ফুট।
ঢামেক ভবন থেকে ফুলার রোড
১৯২১ সালে ঢাবির আবাসিক হল হিসেবে স্থাপিত হয় সলিমুল্লাহ হল। বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের দোতলার কিছু অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে এ হলকে ছেড়ে দেয়া হয়। তখন এর নাম ছিল ‘সেক্রেটারিয়েট মুসলিম হল’। ১৯২৫ সালে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে হলটি ‘রমনা হাউজে’ স্থানান্তরিত হয়। ছাত্র বৃদ্ধিতে ১৯২৫-২৬ সালে মুসলিম হল বিল্ডিং কমিটি গঠিত হয়। ১৯২৭ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদ ভবন তৈরির জন্য ২ লাখ টাকা মঞ্জুর করে। ১৯২৯ সালের ২২ আগস্ট ছোট লাট গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন এ হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯২৯ সালে চামেলি হাউজে (বর্তমান সিরডাপ দপ্তর) এ হল অল্প কিছু দিনের জন্য স্থানান্তরিত হয়েছিল। ১৯৩১ সালের ১১ আগস্ট বর্তমান হলের উদ্বোধন করেন তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন।
কেবলই ছাত্রাবাস নয়, একটি প্রতিষ্ঠান
তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্ররা। প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বইটিতে উঠে এসেছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও জাতীয় জীবনে হলটির সুদূরপ্রসারী প্রভাব। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে এ হলের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে এসএম হলের ১৮ জন শিক্ষার্থী ও কর্মী শহীদ হন। ভাষা আন্দোলনে হলের ছাত্রদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। সে সময়ে বাঙালি মুসলমান সমাজের সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রবিন্দু ছিল হলটি। একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে সাহিত্যচর্চা, নাট্যচর্চা, সংগীতচর্চা, খেলাধুলা, বিতর্কচর্চা সবই হতো এসএম হলে। এ আবাসিক হল থেকেই শুরু হয়েছিল আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দীক্ষা। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ২৫ বছর হলের কার্যক্রম ছিল বহুমুখী। জ্ঞানচর্চা থেকে সমাজসেবা, খেলাধুলা, শিল্প-সংস্কৃতিচর্চা, বাংলা-ইংরেজি বিতর্ক ও বক্তৃতা প্রতিযোগিতা থেকে সাহিত্যচর্চা—সবই হতো এসএম হলে। উপমহাদেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন নজির নেই। প্রথম ৫০ বছর হলটি জাতি গঠন ও সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই ছিল হলের শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের রুটিন। দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় ছাত্ররাজনীতির সূচনা হয়েছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও ফজলুল হক মুসলিম হলে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকেই পরিচালিত হতো অনেক আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ হলের অনাবাসিক ছাত্র ছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ৯৫, ৯৭, ১০৮ ও ১১২ পৃষ্ঠায় তিনি এ হলের স্মৃতিচারণা করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিরোধী রাজনীতির সূতিকাগার ছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। দেশ ভাগের পর ঢাকায় এসে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসএম হলের ছাত্রদের নিয়েই হল চত্বরে সভা করেন। প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৪৮ সালে মুসলিম হল ইউনিয়নের ভিপি (সহসভাপতি) ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ঢাকা সফরকালে এ হলের ছাত্র সংসদের উদ্যোগেই বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল তৎকালীন হলের বিরাট ডাইনিং টেবিলে। এ টেবিলে বসেছেন কাজী নজরুল ইসলাম, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, লর্ড লিটন, স্যার আবদুর রহিম, ফজলুল হক, সুভাষ চন্দ্র বসুসহ উপমহাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা। ষাটের দশকের গণসংগীত অনুষ্ঠান, গণজাগরণের গানের সাক্ষ্য বহন করে চলছে হলের ছাত্র মিলনায়তন। হল ইউনিয়নের আজীবন সদস্যপদ যাদের দেয়া হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি কায়কোবাদ, স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ, বাংলার গভর্নর লর্ড লিটন।
সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এসএম হল
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস কার্যক্রম শুরুর আগেই এসএম হল থেকে ছাত্র ইউনিয়ন গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ১৯২১ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাত সপ্তাহ পর গঠিত হয় মুসলিম হল ইউনিয়ন কমিটি। মুসলিম হল ইউনিয়ন গঠনের পর সাহিত্য বিভাগটি ছিল সবচেয়ে সক্রিয়। ১৯২৫ সালে আত্মপ্রকাশ ঘটে মুসলিম হলের প্রথম প্রকাশনা ‘পতাকা’। এটি একটি হাতে লেখা পত্রিকা। শুধু কবিতা, গল্প, প্রবন্ধই নয়, পত্রিকাটিতে থাকত হলের সমস্যা নিয়ে প্রতিবেদন। হল থেকে প্রকাশিত হতো দ্বিভাষিক ম্যাগাজিন ‘মুসলিম হল ম্যাগাজিন’। প্রথম অংশ ইংরেজি আর দ্বিতীয় অংশ ছিল বাংলায়। মুসলিম হলে যারা সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করতেন, তাদের আদর্শ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই হল ইউনিয়নের সাহিত্য সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা চেয়ে চিঠি লিখতেন। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে প্রকাশিত মুসলিম হল ম্যাগাজিনে রবীন্দ্রনাথের ‘আহ্বান’ কবিতা ছাপা হয়। মুসলিম হলের বর্ধিত অংশ বর্ধমান হাউজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ডিবেটিং ক্লাব ‘আল মামুন ক্লাব’। ইসলামের ইতিহাসের প্রগতিশীল খলিফা আল মামুনের নামে এর নামকরণ। মুসলমান সমাজকে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ধারায় পরিচালিত করতে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ স্লোগানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। হলের ডাইনিং রুমে ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ হলকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হতো সব কার্যক্রম। মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক মুখপত্র শিখা পত্রিকার ঠিকানাও ছিল এ হল। আধুনিক নাট্য আন্দোলনের সূচনাও মুসলিম হল থেকে। বিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুসলিম হলের ভূমিকাই প্রধান।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।