সন্তানের বয়স ছয় মাস হওয়ার পর পরই বুকের দুধের পাশাপাশি শক্ত খাবার খাওয়ানো শুরু করেন মায়েরা। আর তখন থেকে শুরু হয় যুদ্ধ। বাচ্চা কী খাবে না খাবে, তা ডাক্তার ঠিক করবে, নাকি বাড়ির মা-দাদিরা? বাচ্চার মা কার কথা শুনবে, এই নিয়ে চলে এক টানাপড়েন।
চিকিৎসকের নির্দেশ, অন্তত এক বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত শিশুর খাবারে লবণ-চিনি দেওয়া অনুচিত।
তবে বড়রা বলেন, লবণ-চিনি না দিলে খাবারের স্বাদই বা পাবে কিভাবে? যদি শিশুটি কোনোদিন লবণ বা চিনি চেখেই না দেখে, তবে সে কিভাবে ওগুলোর অভাব বোধ করবে? এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন অনেক মা-বাবাই। চিকিৎসকের পরামর্শ বনাম পারিবারিক প্রথা, কার কথা শুনবেন, তাই নিয়ে দ্বিধা।
কেন চিকিৎসকরা নিষেধ করছেন
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর জীবনের প্রথম দুই বছর হচ্ছে ঘরের ভিতের মতো, মজবুত ও টেকসই হলে গোটা জীবনের স্বাস্থ্যের ভিত গড়ে ওঠে। অর্থাৎ, এই সময়ে যা খাবে, তার প্রভাব পড়বে ভবিষ্যতের বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যে ও খাবারের প্রতি মানসিকতায়।
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুর কিডনি পুরোপুরি বিকশিত হয় না, তাই অতিরিক্ত লবণ শরীর থেকে বের হতে পারে না। চিনির প্রভাবে দাঁতে ক্ষয়, খিদে কমে যাওয়া এবং অস্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস তৈরি হয়। চিনি-লবণের অভ্যাস শুরু হলে আজীবনের জন্য মিষ্টি-লবণাক্ত খাবারের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়। কিন্তু মায়ের দুধ, ফরমুলা মিল্ক, ফল আর সবজিতেই শিশুর প্রয়োজনীয় মিষ্টি ও লবণ মেলে।
দুই বছরের কম বয়সী শিশুকে চিনি দিলে কী ক্ষতি
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুকে ছোটবেলায় চিনি খাওয়ালে স্বাভাবিক কম-মিষ্টি খাবার গ্রহণ করতে অনীহা তৈরি হয়। দাঁতের ক্ষয়ও শুরু হতে পারে। অতিরিক্ত চিনি রক্তে হঠাৎ গ্লুকোজ বাড়ায়, যার ফলে খিটখিটে মেজাজ, ঘুমের ব্যাঘাত, এমনকি ভবিষ্যতে স্থূলতা, টাইপ-২ ডায়াবেটিস পর্যন্ত হতে পারে।
তারা আরো বলেন, জীবনের প্রথম ১০০০ দিনে চিনি এড়ালে বড় হয়ে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়।
দুই বছরের কম বয়সী শিশুকে লবণ দিলে কী ক্ষতি
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, অতিরিক্ত লবণ কিডনির ওপর চাপ তৈরি করে।
লবণ খাবারের স্বাভাবিক স্বাদ ঢেকে দেয়, ফলে শিশুর স্বাদবোধ বিকশিত হয় না। ক্যালসিয়ামের ক্ষয় হয়ে হাড় দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
মূলত মায়ের দুধ বা ফরমুলা মিল্কেই শিশু দৈনিক প্রয়োজনীয় সোডিয়াম (প্রায় ০.২ গ্রাম) পেয়ে যায়।
বয়স্করা কেন এই যুক্তি মানতে চান না
চিকিৎসকরা বলেন, অনেকে বলেন, আমরাও তো শিশুকে লবণ-চিনি দিয়েছি, কিছু হয়নি। আসলে তখন এত তথ্য জানা ছিল না। আর এখনকার খাবারে আগে থেকেই অনেক বেশি লুকানো লবণ-চিনি থাকে।
মা-দাদিরা নিজেদের রান্নার অভিজ্ঞতা থেকে মনে করেন, নিরামিষ বা কম তেল-ঝাল-মসলা দেওয়া খাবার মানেই স্বাস্থ্যকর নয়। তাই শিশুর খাবারেও লবণ-চিনি চাই। তাদের সময়ে শিশুর খাবারে সামান্য লবণ-চিনি দেওয়া ছিল ভালোবাসার নিদর্শন। এখন সেটা না করতে বলা হলে তারা মনে করেন খাবার নিরস হয়ে যাচ্ছে, কিংবা ঐতিহ্য নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান দেখিয়েছে, শিশুর জিভ আসলে প্রাকৃতিকভাবেই ফল, সবজি ও শস্যের আসল স্বাদ উপভোগ করার জন্য প্রস্তুত।
শুধু খাবারের বিষয় নয়, এখানে কাজ করে অন্য এক সমীকরণও। প্রবীণদের দৃষ্টিতে শিশুকে লবণ-চিনি না দেওয়া মানে বঞ্চিত করা। তারা ভাবেন, এভাবে শিশুর বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে, নাতি-নাতনিদের খাবারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও তাদের হাত থেকে সরে যাচ্ছে, এই আবেগও কাজ করে।
তাহলে কী খাওয়ানো উচিত শিশুকে
চিকিৎসকরা বলেন, প্রথম দুই বছর লবণ-চিনি না দিয়ে প্রাকৃতিক মিষ্টি যেমন কলা, আম ও সবজির আসল স্বাদ শিশুদের বোঝানো উচিত। এক বছর বয়সের পর ধীরে ধীরে সামান্য লবণ দেওয়া যেতে পারে, তবে চিনি শুধু বিশেষ দিনে। বিকল্প হিসেবে হালকা মসলা, হার্বস বা ফলের স্বাভাবিক মিষ্টি ব্যবহার করা যেতে পারে।
সবশেষে ডাক্তারদের পরামর্শ মা-বাবা ও প্রবীণরা আসলে একই দলের, শিশুর মঙ্গলই সবার লক্ষ্য। ঐতিহ্য মেনে চলা ভালো, তবে চিকিৎসকদের কথাও মানতে হবে। আজকের দিনে শিশুদের সঠিক খাবারের অভ্যাসই তাদের ভবিষ্যতের সুস্থ জীবনের ভিত গড়ে দেবে।
সূত্র : দ্য ওয়াল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।