সিপন আহমেদ ও সাইফুল ইসলাম : মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে মিষ্টির পঁচা গাদ থেকে শিশু খাদ্য সন্দেশ তৈরির কারখানা ফের চালু হয়েছে। তিনজন অসাধু ব্যবসায়ী একাধিক কারখানায় এসব সন্দেশ তৈরি করছেন। আর এক অসাধু ব্যবসায়ী কারখানায় সন্দেশ তৈরি না করলেও বিভিন্ন স্থান থেকে মিষ্টির পঁচা গাদ সংগ্রহ করে তা অন্য একটি কারখানায় সরবরাহ করছেন। আর কয়েকজন তাদের কারখানা সাভার, গাজিপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সরিয়ে নিয়েছেন।
এর আগে গত বছরের ৫ নভেম্বর মিষ্টির পঁচা গাদ দিয়ে সন্দেশ তৈরির একাধিক সদস্য ও ৯টি কারখানার সন্ধান পায় এই প্রতিবেদক। পরদিন ৬ নভেম্বর ‘মিষ্টির পঁচা গাদ দিয়ে নোংরা পরিবেশে তৈরি হচ্ছে সন্দেশ’ শিরোনামে জুমবাংলায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদটিকে গুরুত্ব দিয়ে তাৎক্ষনিক ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে জেলা প্রশাসন। সেনাবাহিনীর সহায়তায় পরিচালিত ভ্রাম্যমান আদালত চারটি কারখানা মালিককে এক লাখ টাকা করে চার লাখ টাকা জরিমানা করেন। একইসঙ্গে বিপুল পরিমাণ মিষ্টির পঁচা গাদ ও সন্দেশ তৈরির কারখানা ধ্বংস করেন।
সন্দেশ তৈরির এসব কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিল দৌলতপুর উপজেলার ধামশ্বর ইউনিয়নের নাটুয়াবাড়ী গ্রামে। ওই গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা এটি। দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কারখানা স্থাপন করে তারা এসব সন্দেশ তৈরি করে আসছিল। সেসব সন্দেশ আবার চমকপ্রদ নানা নামে প্যাকেজিং করে সারা দেশে পাইকারি বিক্রি করতো। এর মধ্যে নাটোরের কাঁচা গোল্লা অন্যতম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাটুয়াবাড়ীতে এখন শুভ রাজ, আলম খান ও রাজিব নামে তিন ব্যক্তি সন্দেশ তৈরির কারখানা চালু রেখেছেন। প্রতিদিনই তাদের কারখানায় তৈরি করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ সন্দেশ। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সন্দেশ উৎপাদন করছেন শুভ রাজ। তার কারখানায় মিষ্টির পঁচা গাদ সরবরাহ করছেন আব্দুর রউফ। আর রাজিব ও আলম খান নিজেরাই বিভিন্ন মিষ্টির দোকান থেকে পঁচা গাদ সংগ্রহ করেন। আলম খান নতুন ব্যবসায়ী। এবারই তিনি প্রথম সন্দেশ তৈরির কারখানা করেছেন। তিনি কলিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি প্রার্থী।
স্থানীয়রা জানান, আলম খানের বড় ভাই নূর খান ও শুভ রাজের হাত ধরে এ গ্রামে মিষ্টির পঁচা গাদ থেকে সন্দেশ তৈরির যাত্রা শুরু। এরপর একে একে বেড়েছে সন্দেশ তৈরির ব্যবসায়ী ও কারখানার সংখ্যা। সিলেটে নূর খানের আর গাজীপুরের কালিয়াকৈরে শুভ রাজের সন্দেশ তৈরির বিশাল কারখানা রয়েছে। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসব সন্দেশ তৈরি করে নূর খান ও শুভ রাজ এখন কোটিপতি। গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি। এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা, ওয়াজ মাহফিল, বাৎসরিক ওরস ও মেলা পরিচালনায় মোটা অংকের অনুদান দেন তারা। ফলে নাটুয়াবাড়ীতে তাদের কথাই ‘আইন’।
গত শনিবার কলিয়া বাজারে কথা হয় রাজিব ও আলম খানের সঙ্গে। তাদের ভাষ্য অনুয়ায়ী, থানা পুলিশ ও কিছু সাংবাদিককে ম্যানেজ করা হয়েছে। মেজিস্ট্রেটের সঙ্গেও কথা হয়েছে। এই প্রতিবেদকের নাম বলেও কে বা কারা টাকা নিয়েছেন। কাজেই এখন তারা নির্বিঘ্নে কারখানা পরিচালনা করছেন।
এ বিষয়ে দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিয়ান নুরেন বলেন, গত বছরের নভেম্বরে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হয়েছিল। এরপর আমরা আরও একবার অভিযানে গিয়েছিলাম। তখন তারা আমাদের ঘিরে ধরেছিল। এক পর্যায়ে তারা বলেছিল আর কারখানা চালাবে না। তবে নতুন করে যদি কারখানা চালু করা হয়, তাহলে খোঁজ নিয়ে সেনাবাহিনীর সহায়তায় আবারও অভিযান চালানো হবে।
অপরদিকে, ঘিওর উপজেলার নারচি এলাকায় মিষ্টির পঁচা গাদ থেকে সন্দেশ তৈরির আরও এক কারখানার সন্ধান পেয়েছে জুমবাংলা। কারখানাটি গড়ে তোলা হয়েছে নারচি গ্রামের রিকশা স্ট্যান্ডের পাশে। মওলা মিয়া ও মনির হোসেন নামের দুই ব্যক্তি এই কারখানাটি পরিচালনা করেন। মওলা ও মনির সম্পর্কে পিতা-পুত্র। কয়েক মাস ধরে তারা এখানে কারখানাটি চালু করেছেন। এর আগে কুস্তা গ্রামে তারা কারখানাটি স্থাপন করেছিলেন।
সরেজমিনে দেখো যায়, নারচি রিকশা স্ট্যান্ডের উত্তর পাশ দিয়ে একটি রাস্তা দৌলতপুর উপজেলার বিষ্ণপুরের দিকে চলে গেছে। আর দক্ষিণে নারচি গ্রামে গেছে আরেকটি রাস্তা। নারচিকে অনেকে ছোট রঘুনাথপুরও বলে। রিকশা স্ট্যান্ড লাগোয়া টিনের একটি লম্বা ছাপড়া ঘর রয়েছে। যেখানে রয়েছে কয়েকটি দোকান। এর পশ্চিমের দোকানটি ভাড়া নিয়েছেন কারখানা মালিক মওলা মিয়া। ছাপড়ার পিছনে গড়ে তোলা হয়েছে সন্দেশ তৈরি সেই কারখানাটি। দোকানের ভিতরে ও সন্দেশ তৈরির কারখানার পাশে ছোট-বড় একাধিক ড্রামে রাখা হয়েছে বিভিন্ন মিষ্টির দোকান থেকে সংগ্রহ করা পঁচা গাদ।
ছাপড়ার উত্তর পাশে একটি ফাঁকা জায়গায় ও পশ্চিম পাশে রাখা আছে চুলা জ¦ালানোর লাকড়ি। ছাপড়ার দোকানগুলোর মাঝে ছোট একটি গলি রয়েছে কারখানার ভিতরে যাওয়ার জন্য। সেটিও আবার টিনের ঝাপ দিয়ে আটকানো। বাহিরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভিতরে এ ধরনের একটি কারখানা রয়েছে। তবে স্থানীয়রা কারখানা সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।
কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, কারখানা মালিক মওলা চুলায় মিষ্টির পঁচা গাদ জ¦াল করছেন। পাশে এক শ্রমিক বড় বড় দুটি ড্রামে রাখা গাদ ছাকনির কাজ করছেন। ছাপড়ার ভিতের এক শ্রমিক সন্দেশ তৈরির কাজ করছেন, আরেকজন সেগুলো প্যাকেট করছেন। পাশেই মিষ্টির গাদ রাখা ড্রামগুলো চেটে খাচ্ছে একটি কুকুর।
মওলা মিয়া বলেন, কি করে খামু, শিখছি এই কাজ। পেট তো চালাতে হবে। আর তার ছেলে মনির জানান, জেলার বিভিন্ন মিষ্টির দোকান থেকে পঁচা গাদ সংগ্রহ করেন তিনি। গাদ সংগ্রহ করার জন্য একটি সিডিউল মেইনটেইন করেন তিনি। সিডিউল অনুয়ায়ী, প্রতিটি দোকান থেকে দশ দিন অন্তর মিষ্টির গাদ সংগ্রহ করা হয়। এক ড্রাম গাদের দাম এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা। প্রতি ড্রামে গাদ ধরে ৬০ কেজি করে। অর্থাৎ প্রতি কেজি গাদে খরচ হয় ৩৫ টাকার মতো।
মনির জানান, গাজিপুর, ফরিদপুর, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাসহ খুলনা এলাকায় সরবরাহ করা হয় তাদের কারখানায় তৈরি সন্দেশ। বিভিন্ন কুরিয়ারের মাধ্যমে সন্দেশগুলো পাঠানো হয়। লেনদেন হয় বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে।
বিষয়টি নিয়ে ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসমা সুলতানা নাসরীনের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড.মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ভেজাল সন্দেশ তৈরির কারখানায় দ্রুত অভিযান চালিয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।