অর্ণব সান্যাল : দুনিয়ায় কত যে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। এই যেমন, বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই পেটেন্ট নিয়ে ফেলেছে ভারত। অর্থাৎ, টাঙ্গাইলে তৈরি শাড়ির ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস পাবে ভারত। বানাবে বাংলাদেশ, নাম হবে ভারতের। অথচ টাঙ্গাইল শহরটা এ দেশেই থেকে যাবে। এটা অনেকটা এমন—পরীক্ষা দেবেন আপনি, আর তাতে পাস করবে আপনার পাশের বাড়ির উড়নচণ্ডী বন্ধু!
হ্যাঁ, এমনটা যে কখনোই ঘটে না, তা না। একটা সময় ছিল, যখন আমাদের দেশে পাবলিক (এসএসসি বা এইচএসসি) পরীক্ষা হলেই পত্রিকার পাতায় নকলের দায়ে ধরা পড়ার খবর আসত। শোনা যেত নানা ধরনের অভিযানধর্মী অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। যেভাবে ইন্ডিয়ানা জোনস নানা উপায়ে গুপ্তধন আবিষ্কার করতেন রূপালি পর্দায়, ঠিক সেভাবেই দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক ও ম্যাজিস্ট্রেটরা কারও শার্ট–প্যান্টের গুপ্ত কোটর থেকে টেনে বের করে আনতেন নকল। এমন যুগও এ দেশে একসময় ছিল, যখন একজনের পরীক্ষা আরেকজন দিতেও পারত। তখন হয়তো একজনের মেধায় আরেকজন পাস করেও ফেলত। অঙ্ক কষত একজন, আর নম্বর গুণত আরেকজন।
তবে সেই যুগ অনেক বছর হলো আমরা পার করে এসেছি। এখন পরীক্ষায় নকলের বা আরেকটু চোস্ত ভাষায় বললে, অসদুপায় অবলম্বনের খবর খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে জাতীয় জীবনের সেই খরাই যেন আন্তর্জাতিক জীবনে এসে কিছুটা ভিন্ন রূপে দেখা দিল! ঘটনাটা অনেকটা এমন হয়ে গেল যে, খেজুর গাছ আপনি লাগিয়েছিলেন রস খাবেন বলে। ভেবেছিলেন, ‘আমারই তো গাছ। নিশ্চয়ই অন্য কেউ এসে মুখ দেবে না!’ তাই গাছে হাঁড়ি বেঁধে আর খোঁজ নেননি। আর এই ফাঁকে পাড়ার দস্যি ছেলেরা রাতের আঁধারে ওই হাড়িই ফুটো করে রস বের করে নিয়েছে অন্য হাঁড়িতে!
মোদ্দা কথা, টাঙ্গাইল থেকে শাড়ি ‘বেড়ু বেড়ু’ করতে করতে বেরিয়ে গেছে। আর বেরিয়ে যাওয়ার পরই জানা গেল, আমরাও নাকি তার বৈশ্বিক কৃতিত্ব দাবি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই, আমরা একটু আলসে কিনা! তাই দুপুরে এন্তার খেয়ে চোখদুটো বুজে গিয়েছিল একটু। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার দেশ, শরীর একটু ঘুম চাইতেই পারে। আরামপ্রিয় হতেই পারে। এটাই কিন্তু সায়েন্স। মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞান অনুযায়ীই এটা অতিসম্ভব। তবে শিয়রে সংক্রান্তি এলেও যে আমাদের ঘুম ভাঙে না, সেটা বোধহয় কুম্ভকর্ণও আমাদের না দেখলে বিশ্বাস করতে চাইবে না!
‘তাই ঘুমের মধ্যেই আমাদের স্বপ্ন চুরি হয়ে গেল…’
এই এই, কিছুটা বিপ্লবী ভাবমূর্তির হয়েছে না লাইনটা। প্রতিবাদী ভাবমূর্তি তো গড়ে তোলা গেছে, নাকি? আশা করি, আপনারা ম্মতিসূচকভাবেই মাথা নাড়ছেন। ঠিক সময়ে ঘুম না ভাঙলেও যেকোনো মুহূর্তে প্রতিবাদী হতে আমাদের জুড়ি নেই কিন্তু। বিশ্বগ্রামের সময়ও তাই আমরা নাক ডেকে ঘুমাতে পারি বেশ। পাশ দিয়ে জলহস্তী দাপিয়ে গেলেও, আমাদের নাক ডাকায় বিঘ্ন ঘটে না। জলহস্তী যাওয়ার সময় দিন–দুনিয়ায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে দিলেও আমাদের নাক ডেকেই যায়। আর ঘুম যখন ভাঙে, তখন দেখা যায়, মাথার ওপর চালই নেই। ঠিক তখনই আমরা জলহস্তী কেন আমার জমিতে হাঁটল, তা নিয়ে আশপাশ গরম করে ফেলি। আশপাশ না পারলেও অন্তত মোবাইল বা ল্যাপটপ অবশ্যই গরম করতে পারি। আর আসল গরম তো টের পায় মার্ক জাকারবার্গ! ওনার ফেসবুকে যে মাত্রার উষ্ণতা আমরা উৎপন্ন করতে পারি, তা বোধ করি পারমাণবিক চুল্লিও পারে না।
সে যাক গে। ফেসবুকের গরম জাকারবার্গ বুঝুক। যার জিনিস, তার মাথাব্যথা। কিন্তু ঘটনা হলো আমাদের দুশ্চিন্তা অন্য বিষয় নিয়ে। শাড়ি তো নিয়ে গেল। ফেরানোর চেষ্টা এখন আমরা করব ঠিকই। যদি ফেরে তাহলে ভালো। না ফিরলে ঝক্কি পোহাতে হবে। তবে যেভাবে টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই মালিকানা প্রতিবেশীরা নিয়ে নিল, সেভাবে যদি অন্য কিছুতেও হাত দেয়, তখন কী হবে?
টাঙ্গাইলের শাড়ি এ দেশের বাঙালির ঐতিহ্যের অংশ। সেটিকেও যখন নিয়ে নিয়েছে, একসময় হয়তো দেখা যাবে শাড়ি তৈরির কারখানাগুলোরও জিআই মালিকানা অন্য কেউ হাতিয়ে নেবে। আশঙ্কা তো থাকেই বলুন? টাঙ্গাইল শহরেও যে হাত দেবে না, তার গ্যারান্টি কী? দেখা গেল, মার্ভেলের অ্যাভেঞ্জার্সদের ডেকে এনে সিনেমার মতো করে শহর উপড়ে তাতে জিআই ট্যাগ লাগিয়ে দিল!
সবচেয়ে বড় ভয় হলো—আবহমান এই বাংলার চিরাচরিত পোশাক, আমাদের ঘুমানোর সঙ্গী, গরিবের এসি, ধনীর আরামের সঙ্গী, ঘর মোছার ন্যাকড়ার জোগানদায়ী উৎস, যেকোনো সময় ফুল বা হাফ লেংথে রূপান্তরিত হওয়ার অস্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন, পশ্চিমা বিশ্বের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া পোশাক-প্রযুক্তি, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্ত—যেকোনো ঋতুতে আমাদের দেশের অধিকাংশ পুরুষের ত্বকের সুরক্ষা প্রদানকারী—হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই লুঙ্গির ভবিষ্যৎ নিয়ে।
যতই বলুন লুঙ্গি মিয়ানমারের, লুঙ্গি ইন্দোনেশিয়ার, লুঙ্গি শ্রীলঙ্কার বা আফ্রিকার, কিন্তু এই লুঙ্গির সর্বোত্তম ব্যবহারকারী বাংলাদেশের এই আমরাই। সেই লুঙ্গিকে তাই অপশক্তির হাত থেকে বাঁচাতেই হবে। লুঙ্গির যত্ন নেব আমরা, আর জিআই ট্যাগ লাগাবে অন্যরা—তা হবে না, তা হবে না।
তাই আসুন, নিজের লুঙ্গিতে অন্যের হাতের স্পর্শ বা হ্যাঁচকা টান লাগার আগেই আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠি। নইলে কিন্তু আপনার লুঙ্গিতে অন্য কেউ ট্যাগ (জিআই বা যা–ই হোক) লাগিয়ে দেবে। তখন কিন্তু মার্ক জাকারবার্গকে কংগ্রেসনাল শুনানি থেকে ডেকে এনে ফায়ারপ্লেসের কাছে বসিয়ে দিলেও আপনি উষ্ণতা অনুভব করতে পারবেন না। কারণ কথায় আছে—‘গ্রন্থগত বিদ্যা আর পর হস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন!’ সূত্র : ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।