আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সেরো রিকো। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়ার এই পর্বতমালা পরিচিত ‘রিচ মাউন্টেন’ নামেও। সেরো রিকোর আক্ষরিক অর্থও তাই, ‘ধনী পর্বতমালা’। বলিভিয়ার পোতোসি শহরের কাছে থাকা এই পর্বতমালার উচ্চতা ১৫ হাজার ফুট। মূল পর্বত ছাড়াও আশপাশে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় পর্বত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ধীরে ধীরে মাটির নীচে তলিয়ে যাচ্ছে এই ধনী পর্বতমালা। কিন্তু কেন এমন অবস্থা হল সেরো রিকোর?
ষোড়শ শতকে বলিভিয়ার সব থেকে বিত্তশালী জায়গা ছিল পোতোসি। কিন্তু এখন তা বলিভিয়ার অন্যতম দরিদ্র শহরে পরিণত হয়েছে। সেই শহরের বাসিন্দাদের ৪০ শতাংশই দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন।
সেরো রিকোকে ‘ধনী পর্বতমালা’ বলা হয় কারণ এটি এক সময় বিভিন্ন আকরিকের ভান্ডার ছিল। মূলত রুপা। রুপার ভান্ডার প্রায় শেষ হয়ে এলেও এখনও সেই খনিতে টিন, দস্তা এবং সীসা পাওয়া যায়।
কথিত আছে, ১৫৪৪ সালে দিয়েগো ওয়ালপা নামে এক স্থানীয় চাষি সেরো রিকোতে প্রথম রুপার খনি খুঁজে পান।
ষোড়শ শতকে পোতোসি শহরের দখল করে নেয় স্পেন। স্পেনের ধনী ব্যবসায়ীরা এসে আসর জমান পোতোসি শহরে। শহরেরই কেচুয়া উপজাতির মানুষদের খনির শ্রমিক বানিয়ে চলতে থাকে খননকার্য।
সেই সময় পোতোসির প্রায় ১৩ হাজার স্থানীয় মানুষ ওই খনিতে কাজ করতেন। রুপার অফুরান ভান্ডার দেখে আফ্রিকা থেকেও ক্রীতদাস এনে খনির শ্রমিক হিসেবে কাজ করানো শুরু হয়। সুড়ঙ্গে খনির গাড়ি চলার জন্য লাইনও পাতা হয়।
স্পেনীয় মালিকদের হয়ে খননকার্য চালানোর পাশাপাশি অকথ্য অত্যাচারেরও শিকার হতে হতো খনির শ্রমিকদের। খনিতে কাজ করার সময় বহু শ্রমিকের মৃত্যুও হতো। আর সেই কারণে সেরো রিকোর নাম হয়ে যায়, ‘মাউন্টেন দ্যাট ইটস্ ম্যান’, অর্থাৎ ‘নরখাদক পর্বত’।
স্পেন পোতোসি দখলের পরের ২০০ বছর ধরে সেই শহরে স্পেনীয় রাজত্ব চলে। মনে করা হয়, সেই সময় সেরো রিকো থেকে সাড়ে তিন কোটি কিলোগ্রামেরও বেশি রুপা খনন করে ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হয়।
মনে করা হয়, সেই সময় স্পেনের হাতে এত রুপা এসে গিয়েছিল যে, সেদেশে রুপার মুদ্রার প্রচলন হয়। ফরাসি সেনাবাহিনীরও খরচ চলতো রুপা থেকে আয় করা অর্থ দিয়ে। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে, বিশ্বের ৮০ শতাংশ রুপার সরবরাহ এই খনি থেকেই আসতো।
এরও প্রায় ১০০ বছর পর বলিভিয়ায় স্পেনীয় রাজত্বের অবসান হলে সেরো রিকোর দখল নেয় সে দেশের খনি সংস্থা ‘কোমিবল’। উদ্দেশ্য ছিল আরো রুপা বের করে আনা।
তবে বিশেষ লাভ হয়নি। কারণ, স্পেনীয়রা ততদিনে যা রুপা লুট করে নিয়ে যাওয়ার তা নিয়ে চলে গেছে। সেরো রিকোয় বিশেষ রুপা আর অবশিষ্ট ছিল না।
১৯৮০-র দশকে রুপার দামে পতন আসার পরে সেরো রিকোর দায়িত্ব স্থানীয়দের হাতে তুলে দেয় ‘কোমিবল’।
কয়েকটি কোঅপারেটিভ এবং সংস্থার দেখভালে সেখানে খননকার্য চালাতে থাকেন স্থানীয়রা। এখনও পোতোসি শহরের প্রায় ১৬ হাজার মানুষের রুজিরুটির জোগান দেয় সেরো রিকো।
দীর্ঘ সুড়ঙ্গের মাধ্যমে সেরো রিকোর বিভিন্ন পর্বতের মধ্যে যোগ রয়েছে। রুপা সেভাবে আর পাওয়া না গেলেও টিন, দস্তা আর সীসার খোঁজে কাজে নামেন স্থানীয়রা। ২০২১ সালে বলিভিয়ার এই খনি থেকে ১৩০ কোটি ডলারের দস্তা বিক্রি হয়েছে।
খনিতে প্রবেশের আগে মূল সুড়ঙ্গের মুখে রাখা এক মূর্তিতে পুপা করেন শ্রমিকেরা। এই মূর্তিটি ‘এল থিয়ো’ বা ‘আঙ্কল’-এর। খনির মুখে থাকা শিংওয়ালা ওই মূর্তি কোকা পাতা, মদ এবং লামার রক্ত দিয়ে পুজা করেন স্থানীয়রা। মনে করা হয়, খনি শ্রমিকদের ভয় দেখানোর জন্য মূর্তিটি সেখানে বসানো হয়েছিল।
এই খনিতে কর্মরত শ্রমিকদের মৃত্যুহার অন্যান্য খনিতে কর্মরত শ্রমিকদের থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি। খনির বেশির ভাগ শ্রমিকই ৪০ বছরের বেশি বাঁচেন না। ধস নেমে মৃত্যুর পাশাপাশি সিলিকোসিস নামে ফুসফুসের এক রোগে আক্রান্ত হয়েও অনেকে মারা যান।
কিন্তু কেন আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে সেরো রিকো? বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, খনন করে করে সেরো রিকো ফাঁপা হয়ে গেছে। এই পাহাড় বাইরে থেকে নিরেট হলেও ভিতর অন্তঃসারশূন্য।
২০১১ সালে সেরো রিকোতে একটি ‘সিঙ্কহোল’ দেখা গিয়েছিল। সিমেন্ট দিয়ে তা ভরাট করা হয়।
সমীক্ষা বলছে, সেরো রিকো পর্বত প্রতি বছর কয়েক সেন্টিমিটার করে ডুবে যাচ্ছে। ২০১৪ সালে সেরো রিকো এবং পোতোসি শহরকে বিপন্ন এলাকার তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে বলিভিয়ার খনি সংস্থা ‘কোমিবল’কেই সেরো রিকোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।