বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার নীতিমালা চূড়ান্ত করতে তৈরি করা একটি খসড়া গাইডলাইনের ওপর মতামত সংগ্রহ করছে।
এ খসড়াটি চূড়ান্ত হলে বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্কের মালিকানাধীন স্টারলিংক কিংবা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহার করে বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার ব্যবসায় আসার সুযোগ পাবে।
স্টারলিংক কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের বাজারে ইন্টারনেট সেবা নিয়ে আসার চেষ্টা করে আসছে। সম্প্রতি তাদের একটি দল ঢাকায় বিনিয়োগ বোর্ডের সাথে এ নিয়ে বৈঠক করেছে।
স্টারলিংক সাধারণ ইন্টারনেট সেবা যেখানে পৌঁছানো যায় না সেখানে কাজ করতে সক্ষম। এ কোম্পানি বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট সেবা দিতে পাঁচ বছর আগে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহও পাঠিয়েছে। ইন্টারনেটের গতি অনেক বেশি হওয়ায় গভীর সমুদ্র বা পাহাড়ি এলাকার মতো দুর্গম জায়গাতেও তারা গেমিং, স্ট্রিমিং ও দ্রুত ডাউনলোড নিশ্চিত করতে পারে।
এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য রেগুলেটরি ও লাইসেন্সিং নীতিমালা চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে যে খসড়া গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে তাতে নজরদারি করার সুযোগ রাখা হয়েছে এবং তা চূড়ান্তভাবে বহাল থাকলে ইন্টারনেট সেবার ওপর সরকারের এখন যে নজরদারি করছে তাতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।
এখন যারা ফাইবার অপটিক বা ক্যাবল ব্যবহার করে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছেন সেই ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার বা আইএসপি ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের শর্ত থাকে, সেটিই নির্ধারণ করবে দেশের ইন্টারনেট ব্যবসা খাতের প্রভাব কেমন হবে।
এ বিষয়ে বিটিআরসি কোনো মন্তব্য করেনি। তবে একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সবার মতামত নেয়ার পর আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত নীতিমালা করে তা প্রকাশ করা হবে।
স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা মানে কী?
মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক মুহাম্মদ এরশাদুল করিম বলছেন, এখন সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ইন্টারনেট পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশে। যা ক্যাবল বা তারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের সংযুক্ত করে। ফলে যেসব এলাকায় ক্যাবল নেয়া সম্ভব হয় না, সেখানে ইন্টারনেট সেবা দেয়া যায় না।
তিনি বলেন, ’দেশের জল, স্থল ও আকাশ সীমায় যেখানে ক্যাবল নেয়া সম্ভব নয় সেখানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়া যাবে। যেমন বর্তমানে অনেকে বিমানে বসেও ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের সুবিধা পাচ্ছে।’
সহজে বিদেশী চ্যানেল দেখার জন্য যেমন অনেকে আকাশ এন্টেনা ব্যবহার করেন তেমনি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা পাওয়ার জন্য একটি এন্টেনা বা ডিভাইস ব্যবহার করতে হবে, যা কৃত্রিম উপগ্রহের সাথে সংযুক্ত থেকে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করবে।
বিটিআরসি গত বছরের শেষে এক তথ্যে জানিয়েছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ১৩ কোটি ১০ লাখ। তবে এর মধ্যে ১১ কোটি ৮৪ লাখ ৯০ হাজার মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী।
সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে?
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো দেশে কাজ করলে সেই দেশের নিয়ম অনুযায়ী ও প্রয়োজনীয় শর্তপূরণ করে লাইসেন্স নিয়ে থাকে। স্টারলিংক বা এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সীমানায় কাজ করতে চাইলে লাইসেন্স নিয়েই কাজ করতে হবে।
এ ব্যাপারে নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পর বোঝা যাবে লাইসেন্স পাওয়ার জন্য কি কি শর্ত কোম্পানিগুলোকে পূরণ করতে হবে।
মুহাম্মদ এরশাদুল করিম বলেন, এখন পর্যন্ত খসড়া গাইডলাইনে যা রাখা হয়েছে তাতে সরকার যদি মনে করে, এটা হুমকি হয়ে যাচ্ছে তাহলে তা বন্ধ করে দিতে পারবে।
এ বিষয়ে প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, এখানে স্টারলিংক আসলেও গাইডলাইন অনুযায়ী গেটওয়ে হিসেবে বাংলাদেশের হাব ব্যবহার করতে হবে। তাতে যদি কোম্পানিগুলো রাজি হয় তাহলে সরকার তা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
এরশাদুল করিম আরো বলেন, সব দেশেই এর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সরকারের কাছেই থাকে। তবে অনেক দেশে নাগরিক সুরক্ষার আইনিব্যবস্থা আছে, যা বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশের গেটওয়ে ব্যবহার করে স্টারলিংককে কাজ করতে হবে। এমন একটা গেটওয়ে দিয়ে তাকে ঢুকতে হবে যার মালিক হলো সরকার। ফলে স্টারলিংক আসলে একটা বিকল্প হতে পারে। কিন্তু আগের মতো নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতেই থাকবে।
বাংলাদেশে সরকার বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রায় নাগরিকদের ইন্টারনেটে নজরদারি করার বিষয়ে অভিযোগ ওঠে এ নিয়ে এরশাদুল করিম বলেন, কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপটা সুনির্দিষ্ট, আইনি ও যৌক্তিক হতে হবে। এমন যেন না হয়, সরকার ইচ্ছে করলে চালু রাখবে আবার ইচ্ছে করলে বন্ধ করবে। একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। এজন্য গ্রাহকদের ডেটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনার সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছিলো, এতে দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছিলে।
কী আছে গাইডলাইনে
মুহাম্মদ এরশাদুল করিম ও সুমন আহমেদ সাবির বলেন, খসড়া গাইডলাইনে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা হয়েছে। ‘নন–জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) স্যাটেলাইট সার্ভিসেস অপারেটর’- শীর্ষক ওই গাইডলাইনে বলা হয়েছে, লাইসেন্স পাবে তার সিস্টেমে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে এমন ব্যক্তিদের শনাক্তকরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে করে সরকারি কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারে।
এছাড়া এখন যেমন সরকারি কর্তৃপক্ষের বাংলাদেশের গেটওয়েগুলোতে যে কোনো সময় প্রবেশের অধিকার আছে ঠিক তেমনি ‘নজরদারি প্রক্রিয়ায় ডেটা দেয়ার’ ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে গ্রাহকদের ওপর নজরদারির সুযোগ থেকেই যাবে। এছাড়া খসড়া গাইডলাইন অনুযায়ী নজরদারি সংক্রান্ত সরকারের যে নীতি সেটিও প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেনে চলতে হবে। পাশাপাশি বেআইনি কার্যকলাপ বা নাশকতা শনাক্তের প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মানতে হবে।
তবে এসব বাধ্যবাধকতা ও গ্রাহকদের ওপর নজরদারির এত ব্যবস্থার নির্দেশনা মেনে নিয়ে স্টারলিংকের মতো প্রতিষ্ঠান শেষ পর্যন্ত লাইসেন্স নিতে রাজি হয় কি না তা নিয়েও কৌতূহল আছে অনেকের মধ্যে।
এখনকার সাথে পার্থক্য কী হবে
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, চূড়ান্তভাবে সরকারের অনুমোদন নিয়ে স্টারলিংক বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আসলেও তা বাংলাদেশের ইন্টারনেট সেবাদাতাদের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না।
এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা পেতে ব্যয় কিছুটা বেশি হবে ফলে হোম ইউজারদের ক্ষেত্রে খুব একটা পরিবর্তন আসবে না।
তবে সুমন আহমেদ সাবির বলেন, কর্পোরেট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাকআপ হিসেবে স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার সাথে সংযুক্ত হবে। সব মিলিয়ে লোকাল আইএসপিগুলোর ওপর খুব একটা প্রভাব পড়বে বলে মনে করি না।
এরশাদুল করিম বলেন, এখন বাজারে কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে এবং স্টারলিংক এলে বাজারে এর প্রভাব কিছুটা পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
উল্লেখ্য, এখন বাজারে ছোট বড় মিলিয়ে তিন হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেট সার্ভিস দিয়ে আসছে। যারা মূলত হোম ইউজারদেরই বেশি সেবা দিচ্ছে।
ইন্টারনেট প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি আনোয়ারুল আজিম বলেন, স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেটের ব্যয় বেশি হওয়ায় হোম ইউজার পর্যায়ে প্রভাব কম পড়লেও কর্পোরেট গ্রাহকরা সেদিকে ঝুঁকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আইএসপিরা কিছু গ্রাহক হারাবে। তবে দেখতে হবে যে সরকার কোন পর্যায়ে কি ধরনের রেস্ট্রিকশন দিয়ে লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটিও বিবেচনায় নিতে হবে যে শিপিং ও রিমোট এরিয়ার জন্য স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট দরকার আছে। আমরা দেখবো কীভাবে সে পরিকল্পনা করা হয়।
এ বিষয়ে এরশাদুল করিম বলেন, স্টারলিংক বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান এলে অধিকতর ভালো সেবা নিশ্চিত হবে। কারণ প্রযুক্তিগতভাবে এসব কোম্পানি অনেক বেশি উন্নত। তবে এসব কারণে আবার তাদের ওপর বেশি নির্ভরতা তৈরি হতে পারে। এছাড়া স্টারলিংকের কারিগরি দক্ষতার কারণে অন্য কোম্পানি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। ফলে প্রতিযোগিতা ও বাজারের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
উল্লেখ্য, বিশ্বের কমপক্ষে ৫০টি দেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম রয়েছে। গত বছরের জুলাই মাসে স্টারলিংকের প্রযুক্তি বাংলাদেশে এনে পরীক্ষা করা হয়েছিলো। সংস্থাটির উদ্দেশ্য হলো, বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা।
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।