বিজ্ঞান ও প্রযক্তি ডেস্ক : সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা ইলিশের অন্ত্রে কিছু নতুন প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করেছেন। এসব ব্যাকটেরিয়া ইলিশকে রোগের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক। প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া জীবদেহে বসবাসকারী অণুজীব, যা পোষকের বৃদ্ধি, উন্নয়ন, রোগ প্রতিরোধসহ প্রতিবেশে অভিযোজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বিজ্ঞানীরা এমন নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করেছেন, যা আগে কোনো মিঠাপানি বা সামুদ্রিক মাছে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি) এবং যুক্তরাজ্যের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী পিএলওএস ওয়ানে সম্প্রতি ‘আনভেইলিং দ্য গাট ব্যাকটোরিয়াম ডাইভারসিটি অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন ইন দ্য ন্যাশনাল ফিশ হিলসা অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। ছয়জনের গবেষণা দলের পাঁচজনই বাংলাদেশী।
গবেষকরা জানিয়েছেন, মেটাজিনোমিক্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইলিশের অন্ত্রের অণুজীবগুলোর গঠন ও বৈচিত্র্য উদঘাটন করা হয়। ওই গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন বশেমুরকৃবির ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (আইবিজিই) অধ্যাপক ড. তোফাজ্জল ইসলাম। বিজ্ঞানী দল মেটাজিনোমিক্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ইলিশ মাছের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতি বৈচিত্র্য এবং এদের আপেক্ষিক সংখ্যা নির্ণয় করেন। বাংলাদেশে ইলিশের প্রধান প্রধান আবাসস্থল, যথাক্রমে চাঁদপুর, পটুয়াখালী, কক্সবাজার, মুন্সিগঞ্জ ও রাজশাহীতে পাওয়া মাছের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার কৌলিক বৈশিষ্ট্যাবলি এবং স্বাতন্ত্র্য বিশ্লেষণ করেন তারা এবং ইলিশের অন্ত্রে অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কিছু নতুন ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পান।
পৃথিবীজুড়ে মাছের বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধের জন্য অ্যাকুয়াকালচারে ব্যবহার করা হয় প্রোবায়োটিক ফর্মুলেশন। এটিতে সরাসরি কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের পরিবর্তে মাছের খাবারের সঙ্গে খাওয়ানো হয় সুনির্দিষ্ট জীবন্ত উপকারী ব্যাকটেরিয়া, যা মাছের রোগ প্রতিরোধ ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
বর্তমানে বাংলাদেশের অ্যাকুয়াকালচারে বিদেশ থেকে আমদানি করা জীবন্ত ব্যাকটেরিয়া প্রোবায়োটিক ফর্মুলেশনের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশা, ইলিশের অন্ত্রে পাওয়া উপকারী এসব ব্যাকটেরিয়া দেশের অন্যান্য মাছের খাবারের সঙ্গে প্রয়োগ করা গেলে দেশের অ্যাকুয়াকালচারে তৈরি হতে পারে নতুন সম্ভাবনা। তবে ইলিশের অন্ত্রে আবিষ্কৃত এসব নতুন ব্যাকটেরিয়া কোন রোগ প্রতিরোধের জন্য কাজ করবে, সে বিষয়ে গবেষণা চলমান।
এ গবেষণার দলনেতা বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো এবং বশেমুরকৃবির আইবিজিইর অধ্যাপক ড. তোফাজ্জল ইসলাম বণিক বার্তাকে জানান, এ গবেষণায় শনাক্তকৃত ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ল্যাকটোকক্কাস, মরগানেলা, এন্টেরোকক্কাস, অ্যারোমোনাস, শিওয়েনেলা, পেডিওকক্কাস, লিওকোনস্টক, স্যাক্কারোপোরা ও ল্যাকটোব্যাসিলাস উল্লেখযোগ্য প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া। মাছের বাস্তুতন্ত্রে বিচরণকারী এসব প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ইলিশের রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এছাড়া এসব ব্যাকটেরিয়া ইলিশের স্বাদ গঠনেও ভূমিকা রাখে।
এ গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য ড. এম নাজমুল হক জানান, গবেষণার একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হলো নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়া (সাইনোবাকা, সায়েনোকক্কাস, গেমাটা সেরেনিকক্কাস, স্যাক্কারোপলিস্পোরা ও পলিনেলা) শনাক্তকরণ, যা আগে কোনো মিঠাপানি বা সামুদ্রিক মাছের প্রজাতিতে লক্ষ করা যায়নি। এ ধরনের অগ্রসরমাণ গবেষণা ইলিশ মাছের টেকসই উন্নয়নে ব্যবহার করা যেতে পারে।
সমুদ্র থেকে নদীতে বিচরণকারী ইলিশ মাছ কখনো রোগাক্রান্ত হয়েছে, এমন কোনো গবেষণা প্রবন্ধ বা প্রতিবেদন নেই। সুতরাং নতুন আবিষ্কৃত প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াগুলো ইলিশের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। এসব ব্যাকটেরিয়াকে আলাদা করে বাণিজ্যিকভাবে প্রোবায়োটিক হিসেবে দেশের মৎস্য চাষে ব্যবহারে সম্ভাবনার কথাও বলেন তারা।
উল্লেখ্য, ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ এবং এ দেশের একটি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃত। এটি একটি আইকনিক ফ্ল্যাগশিপ প্রজাতি হিসেবে বিখ্যাত। ব্যতিক্রম স্বাদের কারণে ইলিশ মাছের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক মূল্য এবং দেশ ও বিশ্বব্যাপী এর উচ্চ চাহিদা রয়েছে। এটি বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক আন্তঃসীমান্ত প্রজাতি হিসেবে পরিচিত। উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছাড়াও ইলিশ অপরিসীম আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহন করে। দেশে মোট উৎপাদিত ইলিশ মাছের বার্ষিক মূল্য ১৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের জিডিপির ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের ৪ মিলিয়ন মানুষের জীবিকা এর সঙ্গে জড়িত। এর বাইরে আনুমানিক আড়াই মিলিয়ন মানুষ বিস্তৃত ভ্যালু চেইনের সঙ্গে জড়িত। এ মাছ দেশের মোট মাছ উৎপাদনে প্রায় ১২ শতাংশ অবদান রাখে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।