মাওলানা কাওসার আহমদ যাকারিয়া : মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি পরিয়ে দেন রাতের ওপর দিনকে এমতাবস্থায় যে, দিন দৌড়ে দৌড়ে রাতের পেছনে আসে। তিনি সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র স্বীয় আদেশের অনুগামী। শুনে রেখো, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ দান করা। আল্লাহ বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক’ (সূরা আল-আ’রাফ-৫৪)।
আলোচ্য আয়াতে নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি করা এবং একটি বিশেষ অটল ব্যবস্থার অনুগামী হয়ে তাদের নিজ নিজ কাজে নিয়োজিত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালার অসীম শক্তির কথা বর্ণনা করে প্রত্যেক বুদ্ধিমান মানুষকে চিন্তার আহ্বান জানানো হয়েছে যে, যে পবিত্র সত্তা এ বিশাল বিশ্ব সৃষ্টি করতে এবং বিজ্ঞজনোচিত ব্যবস্থাধীনে পরিচালনা করতে সক্ষম, তাঁর জন্য এসব বস্তুকে ধ্বংস করে কিয়ামতের দিন পুনরায় সৃষ্টি করা কি কঠিন কাজ?’
তাই কিয়ামতকে অস্বীকার না করে একমাত্র তাঁকেই স্বীয় পালনকর্তা মনে করো, তার কাছেই প্রয়োজনাদি প্রার্থনা করো, তাঁরই ইবাদত করো এবং সৃষ্টি বস্তুকে পূজা করার পঙ্কিলতা থেকে বের হয়ে সত্যকে চিন।’ এ আয়াতে বলা হয়েছে- আল্লাহ তায়ালাই তোমাদের পালনকর্তা। তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। এখানে প্রশ্ন হয় যে, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালা সমগ্র বিশ্বকে মুহূর্তের মধ্যে সৃষ্টি করতে সক্ষম। স্বয়ং কুরআন মাজিদেও বিভিন্ন ভঙ্গিতে এ কথা বারবার বলা হয়েছে। কোথাও বলা হয়েছে- ‘এক নিমিষের মধ্যে আমার আদেশ কার্যকরী হয়ে যায়।’
কোথাও বলা হয়েছে- ‘আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো বস্তুকে সৃষ্টি করতে চান, তখন বলে দেন : হয়ে যাও। আর সাথে সাথে তা সৃষ্টি হয়ে যায়।’ এমতাবস্থায় বিশ্ব সৃষ্টিতে ছয় দিন লাগার কারণ কি?
তাফসিরবিদ হজরত সায়িদ ইবনে জুুবায়ের রহ: এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আল্লাহ তায়ালার মহাশক্তি নিঃসন্দেহে এক নিমিষে সব কিছু সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু মানুষকে বিশ্ব ব্যবস্থা পরিচালনায় ধারাবাহিকতা ও কর্মপক্বতা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যেই এতে ছয় দিন ব্যয় করা হয়েছে।
নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও গ্রহ-উপগ্রহ সৃষ্টির আগে দিবা-রাত্রির পরিচয় কি ছিল? দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, সূর্যের পরিক্রমণের ফলে দিন ও রাত্রির সৃষ্টি। নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টির আগে যখন চন্দ্র-সূর্যই ছিল না, তখন ছয় দিনের সংখ্যা কি হিসাবে নিরূপিত হলো?
কোনো কোনো তাফসিরবিদ বলেছেন, ছয় দিন বলে এতটুকু সময় বোঝানো হয়েছে, যা এ জগতের হিসাবে ছয় দিন হয়। কিন্তু পরিষ্কার ও নির্মল উত্তর এই যে, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে দিন এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত যে রাত এটি এ জগতের পরিভাষা। বিশ্ব সৃষ্টির আগে আল্লাহ তায়ালার কাছে দিবা-রাত্রি সূর্যের পরিক্রমণের অনুগামী হবে না।
সহিহ রেওয়ায়েত অনুযায়ী যে ছয় দিনে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে তা রোববার থেকে শুরু করে শুক্রবারে শেষ হয়। শনিবারে জগৎ সৃষ্টির কাজ হয়নি। কোনো কোনো আলেম বলেন, এ দিনে কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে এ দিনকে (শনিবার) বলা হয় (ইবনে কাছির)।
আলোচ্য আয়াতে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি ছয় দিনে সমাপ্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সূরা হামিম সেজদার নবম ও দশম আয়াতে এর বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে- দু’দিনে ভূমণ্ডল, দু’দিনে ভূমণ্ডলের পাহাড়, সমুদ্র, খনি, বৃক্ষ, উদ্ভিদ এবং মানুষ ও জন্তু-জানোয়ারের পানাহারের বস্তুসামগ্রী সৃষ্টি করা হয়েছে। মোট চার দিন হলো।
বলা হয়েছে- ‘যে দু’দিনে ভূমণ্ডল সৃষ্টি করা হয়েছে, তা ছিল রোববার ও সোমবার। দ্বিতীয় দু’দিন ছিল মঙ্গলবার ও বুধবার, যাতে ভূমণ্ডলের সাজসরঞ্জাম পাহাড়, নদী ইত্যাদি সৃষ্টি করা হয়।’
এরপর বলা হয়েছে- ‘অর্থাৎ, অতঃপর সাত আকাশ সৃষ্টি করেন দু’দিনে। বাহ্যত : এ দু’দিন হবে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার পর্যন্ত ছয় দিন হলো।
নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃজনের কথা বর্ণনার পর বলা হয়েছে- ‘অতঃপর আরশের উপর অধিষ্ঠিত হলেন। ইস্তাওয়া-এর শাব্দিক অর্থ অধিষ্ঠিত হওয়া। আরশ রাজসিংহাসনকে বলা হয়। এখন আল্লাহর আরশ কিরূপ এবং কি- এর উপর অধিষ্ঠিত হওয়ার অর্থই বা কি? এ সম্পর্কে নির্মল, পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ মাজহাব সাহাবি ও তাবেয়িদের কাছ থেকে এবং পরবর্তীকাল সুফি-বুজুুর্গদের কাছ থেকে এরূপ বর্ণিত হয়েছে যে, মানব জ্ঞান আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলির স্বরূপ পূর্ণরূপে বুঝতে অক্ষম।
এর অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হওয়া অর্থহীন; বরং ক্ষতিকরও বটে। এ সম্পর্কে সংক্ষেপে এরূপ বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত যে, এসব বাক্যের যে অর্থ আল্লাহ তায়ালার উদ্দিষ্ট, তাই শুদ্ধ ও সত্য। এরপর নিজে কোনো অর্থ উদ্ভাবন করার চিন্তা করাও অনুচিত।
হজরত ইমাম মালেক রহ.-কে কেউ আরশিস্তাওয়া-এর অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ইস্তাওয়া শব্দের অর্থ তো জানাই আছে, কিন্তু এর স্বরূপ ও অবস্থা মানব বুদ্ধি সম্যক বুঝতে সক্ষম। এতে বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়াজিব। এর অবস্থা ও স্বরূপ জিজ্ঞেস করা বিদয়াত। কেননা, সাহাবায়ে কেরাম রা: রাসূলুল্লাহ সা:-কে এ ধরনের প্রশ্ন করেননি। সুফিয়ান সওরি, ইমাম আওযায়ি, লাইস ইবনে সাদ, সুফিয়ান ইবনে ওয়াইনা, আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক রহ: প্রমুখ বলেছেন, যেসব আয়াত আল্লাহ তায়ালার সত্তা ও গুণাবলি সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে, সেগুলোর প্রতি যেভাবে আছে সেভাবে রেখেই কোনোরূপ ব্যাখ্যা ও সদর্থ ছাড়াই বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত (মাজহারি)।
এরপর বলা হয়েছে- আল্লাহ তায়ালা রাত্রি দিয়ে দিনকে সমাচ্ছন্ন করেন এভাবে যে, রাত্রি দ্রুত দিনকে ধরে ফেলে। উদ্দেশ্য এই যে, সমগ্র বিশ্বকে আলো থেকে অন্ধকারে অথবা অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসেন। দিবা-রাত্রির এ বিরাট পরিবর্তন আল্লাহর কুদরতে অতি দ্রুত ও সহজে সম্পন্ন হয়ে যায় মোটেই দেরি হয় না।
এরপর বলা হয়েছে- আল্লাহ তায়ালা সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রসমূহকে এমতাবস্থায় সৃষ্টি করেছেন যে, সবাই আল্লাহ তায়ালার নির্দেশের অনুগামী।
এতে প্রত্যেক বুদ্ধিমানের জন্য চিন্তার খোরাক রয়েছে। বড় বড় বিশেষজ্ঞদের তৈরি মেশিনসমূহে প্রথমত কিছু না কিছু দোষ-ত্রুটি থাকে। যদি দোষ-ত্রুটি নাও থাকে, তবুও যত কঠিন ইস্পাতের মেশিন ও কলকব্জাই হোক না কেন, চলতে চলতে তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং এক সময় ঢিলে হয়ে পড়ে। ফলে মেরামত গ্রেসিং দরকার হয়। এ জন্য কয়েক দিন বরং অনেক সময় কয়েক সপ্তাহ ও কয়েক মাস তা অকেজো পড়ে থাকে।
কিন্তু আল্লাহ তায়ালার নির্মিত মেশিনের প্রতি লক্ষ করুন, প্রথম দিন যেভাবে এগুলো চালু করা হয়েছিল, আজো তেমনি চালু রয়েছে। এগুলোর গতিতে কখনো এক মিনিট কিংবা এক সেকেন্ডের পার্থক্য হয় না। কখনো এগুলোর কোনো কলকব্জা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না এবং কখনো ওয়ার্কশপে পাঠাতে হয় না। কারণ, এগুলো শুধু আল্লাহর আদেশে চলছে।
অর্থাৎ, এগুলো চালানোর জন্য না বিদ্যুৎশক্তির প্রয়োজন হয়, না কোনো ইঞ্জিনের সাহায্য নিতে হয়; বরং শুধু আল্লাহর আদেশের শক্তিবলেই চলছে। এ চলার গতিতে বিন্দুমাত্র পার্থক্য আসাও অসম্ভব। তবে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা নিজেই যখন নির্দিষ্ট সময়ে এগুলোকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করবেন, তখন গোটা ব্যবস্থাই তছনছ হয়ে যাবে। আর এরই নাম হলো কিয়ামত।
কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার পর আল্লাহ তায়ালার অসীম ক্ষমতা একটি সামগ্রিক বিধির আকারে বর্ণনা করে বলা হয়েছে-
সৃষ্টিকর্তা হওয়া এবং আদেশদাতা হওয়া আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। অন্য কেউ না সামান্যতম বস্তু সৃষ্টি করতে পারে, আর না কাউকে আদেশ করার অধিকার রাখে।
তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে কাউকে কোনো বিশেষ বিভাগ বা কার্যভার সমর্পণ করা হলে তাও বস্তুত আল্লাহ তায়ালারই আদেশ। তাই আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, এসব বস্তু সৃষ্টি করাও তাঁরই কাজ এবং সৃষ্টির পর এগুলোকে কর্মে নিয়োগ করাও অন্য কারো সাধ্যের বিষয় নয়; বরং আল্লাহ তায়ালাই অসীম শক্তির কারসাজি।
লেখক : ইসলামী কলামিস্ট, মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।