বিজ্ঞান ও প্রযক্তি ডেস্ক : ডার্ক এনার্জির প্রতক্ষ্য প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। আসলে এধরনের শক্তির প্রতক্ষ্য প্রমাণ আদৌ পাওয়া যাবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা। কিন্তু ডার্ক এনার্জির সন্ধান কেবল সুপারনোভা পর্যবেক্ষণেই মেলেনি। আরও কিছু পর্যবেক্ষণে এই শক্তি ধরা পড়েছে।
প্রথমেই আসা যাক, ভেরা রুবিনের কথায়। সেই ষাটের দশকেই এই মার্কিন বিজ্ঞানী বলেছিলেন, মহাবিশ্বের প্রায় ৭৫ ভাগ জুড়ে রয়েছে অদৃশ্য ডার্ক এনার্জি। তিনি গ্যালাক্সি ক্ল্যাস্টারের গতি-প্রকৃতি থেকে এই হিসাব বের করেছিলেন। নব্বই দশকে সুপারনোভা অনুসন্ধানীরা একেবারে ডার্ক এনার্জির প্রমাণের চেষ্টা করলেন।
ডার্ক এনার্জির অস্তিত্বের প্রমাণ প্রথম মিলেছে সিএমবিআরের অনুসন্ধান করতে গিয়ে।
সিএমবিআরটা কী?
সিএমবিআর এর পূর্ণরূপ হলে কসমোলজিক্যাল মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন। এর একটা বিদঘুটে বাংলা আছে। আমরা সেই বাংলা নামটা এখানে ব্যবহার করব না।
তারচেয়ে বরং সিএমবিআর অনেক ভালো শোনাবে।
এখন আমাদের জানা দরকার. এই সিএমবিআরে চরিত্র আর একে কীভাবে আরও ভালোভাবে চেনা গেল, সেই বিষয়গুলো। কারণ এর সঙ্গে ওৎপ্রাতভাবে জড়িয়ে আছে ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জির ইতিহাস।
মহাবিস্ফোরণের প্রথম তিন মিনিটের পরের ১৭ মিনিট ধরে চলে নিউক্লিয় বিক্রিয়া। অবশ্য ফিশন নয় ফিউশন।
প্রোটন আর নিউট্রনগুলো পরস্পরের খুব কাছাকাছি চলে আসে। এত কাছে, যে প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যও অতিক্রম করে ফেলে। ফলে সক্রিয় হয়ে ওঠে সবল নিউক্লিয় বল। নিউট্রন আর প্রোটন যুক্ত হয়ে তৈরি করে হাউড্রোজেন নিউক্লিয়াস। অন্যদিকে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের সাথে আরো নিউট্রন, প্রোটন যুক্ত হয়ে তৈরি করে হিলিয়াম ও লিথিয়ামের নিউক্লিয়াস। ১৭ মিনিট ধরে ঘটে এই ঘটনা। তখন মাবিশ্বের তাপমাত্রা নেমে এসেছে ১০০ কোটি ডিগ্রিতে। এই যুগের পরেই সাময়িকের জন্য নিউক্লিয়ার ফিউশন বন্ধ হয়ে যায়। এর পরেই শুরু হয় ফোটন যুগ। এর শেষ মহাবিশ্বের বয়স ৩ লাখ ৪০ হাজার বছর পর। এই যুগে মহাবিশ্ব আসলে একটা প্লাজমা অবস্থার স্যুপ। আছে পরমাণুদের নিউক্লিয়াস আর আছে মুক্ত ইলেকট্রন। সেই সাথে বিকিরণ, অর্থাৎ ফোটনের ছড়াছড়ি। এার অবশ্য কারণ আছে। অধিকাংশ লেপটনই প্রতি-লেপটনের সাথে মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেছে। রয়ে গেছে ফোটন বা বিকিরণ আলোক শক্তি। বিকিরণ আছে ঠিকই, কিন্তু মহাবিশ্ব দৃশ্যমান নয়। ফোটনগুলো তখনো ব্যস্ত মুক্ত ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউক্লাসদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে। এসময় মহাবিশ্ব অস্বচ্ছ অবয়ব নিয়ে বেঁচেছিল সে যুগে। এরপরে মহাবিশ্ব দৃশ্যমান হতে শুরু করে। কারণ ততোদিনে ধীরে ধীরে প্লাজমা অবস্থা থেকে মুক্ত হতে শুরু করেছে মহাবিশ্ব। তাপমাত্রা নেমে এসেছে তিন হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
এরপরের ৪০ হাজার বছর হলো পুণর্গঠন যুগ। ইংরেজিতে যাকে বলে রিকম্বিনেশন এপক। এতকিছু ঘটছে, সেইসাথে ঘটছে মহাবিশ্বর প্রসারণও। তাই প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা। এই সময়ে এসে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা দাঁড়ায় মাত্র তিন হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আমরা বোধ হয় সবাই জানি, সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা এই তাপমাত্রার কাছাকাছি। এই যুগে এসে অভাবিত একটা ঘটনা ঘটে। তাপমাত্রা অনেক কমে গেছে। তাই নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটার মতো তাপমাত্রা তখন আর অবশিষ্ট নেই। কমে গেছে নিউক্লিয়াসদের ছোটাছুটির হার। তখন এদের ঘাড়ে চেপে বসেছে ফোটন কণিকারা। এরা বিদ্যুত্চুম্বকীয় বলের বাহক। সেই বলের সাহায্যে এরা ধণাত্মক চার্জে চার্জিত নিউক্লিয়াস আর ঋণাত্মক চার্জের ইলেকট্রনের মধ্যে একটা বন্ধন তৈরি করে ফেলে। তৈরি হয় একটা আস্ত পরমাণু। হাইড্রোজেনর নিউকিক্লাসের সাথে ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে তৈরি করে হাইড্রোজেন পরমাণু, অন্যদিকে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস আর ইলেকট্রনরা মিলে তৈরি করে হিলিয়াম পরমাণু। হিলিয়াম আর হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের পরিমাণ এমন ছিল, মহাবিশ্বের ৭৫ শতাংশ বস্তুর পরিমাণ হাউড্রোজেন আর ২৫ শতাংশ দাঁড়াল হিলিয়াম।
বিগ ব্যাংয়ের তিন লাখ আশি হাজার বছর পর এই যুগের সমাপ্তি ঘটে। তখন ফোটন কণাগুলি মুক্ত হয়ে যায়। ছড়িয়ে পড়ে মাবিশ্বের সর্বত্র। দৃশ্যমান হয়ে ওঠে মহবিশ্ব। এই যে ফোটনগুলি ছড়িয়ে পড়ল সেগুলোই হলো কসমোলজিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা সিএমবিআর। আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে দেখেছিলাম দুই মার্কিন বিজ্ঞানী অর্নো পেনজিয়াস আর রবার্ট উইলসন কীভাবে এই অজ্ঞাত এক মহাজাগতিক তরঙ্গ আবিষ্কার করতে গিয়ে সিএমবিআরের দেখা পান। এরজন্য তাঁরা নোবেল পুরস্কারও পান। তাঁরা হিসাব করে দেখেছিলেন, এই সিএমবিআরের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস। আসলে এর তাপমাত্রা আরও কম।
মহাবিশ্বর অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ, এর আকার-আকৃতি, এর প্রসারণ- ইত্যাদি বিষয়গুলো জানতে সিএমবিআরের অনুসন্ধানের বিকল্প নেই। পেনজিয়াস আর উইলসন পৃথিবীতে বসেই সিএমবিআর আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু মহাবিশ্বে এই সিএমবিআর কীভাবে, কী মাত্রায় ছড়িয়ে আছে, তার হাল-হকিকত না জানলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিস্তুরারিত জানা সম্ভব নয়। তেমনি ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জিদের সঠিক পরিমাণ, মহাবিশ্বে এদের ভূমিকা কতটা গুরুত্ব, সেসব বিস্তারিত জানা কঠিন।
তাই সিএমবিআরকে আরও স্পষ্টভাবে জানার জন্য মার্কিন মহাকাশ সংস্থা ১৯৮৯ সালে একটি নভোযান পাঠায় মহাকাশে। সেই নভোযানটির নাম কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড এক্সপ্লোরার বা সিওবিই (COBE)। আমরা বলব কোব। শুধু সিএমবিআর নয়। মহাবিস্ফোরণের পরে আমরা যে স্ফিতির যুগের কথা বলেছিলাম, যেটাকে বলে ইনফ্লেশন, সেই ইনফ্লেশন তত্ত্ব সত্যি কিনা সেটা সত্যি কিনা তারও প্রমাণ পেতে চাইলেন বিজ্ঞানীরা এই কোব নভোযানের সাহায্যে।
কোব-এর পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায় সিএমবিআরের বৈশিষ্ট্য একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখা কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের মতো, যাকে ইংরেজিতে বলে ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন। কিন্তু কি সেই কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ। তার দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক। কোনো বস্তুর ওপর বির্কীণ তাপ পড়লে সেখানে তিনটি ঘটনা ঘটে। কিছু কিছু বিকির্ণ শক্তি ওই বস্তুটা শোষণ করে। কিছু পরিমাণ বিকির্ণ শক্তি বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয়। কিছু শক্তি ওই বস্তু ভেদ করে চলে যায়, ঠিক যেমনটা ঘটে আলোর ক্ষেত্রে। অনেকে হয়তো বলবেন, বস্তু স্বচ্ছ না হরে আলো ভেদ করে যায় কীভাবে?
দৃশ্যমান আলো অস্বচ্ছ বস্তু ভেদ করতে পারে না। রেডিও তরঙ্গ, এক্স রে, গামা রে এদের কিন্তু ভেদনক্ষমতা যথেষ্ট। আসলে আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ওপর নির্ভর করে সে অস্বচ্ছ বস্তু ভেদ করতে পারবে কি পারবে না। বিকির্ণ তাপ বা শক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু এমন কোনো বস্তু আছে যে আলোকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিতে পারে?
সবরকম আলো, বিকীর্ণ তাপ শক্তি সে বস্তু শোষণ করবে, এমন একটা বস্তুর কথা ভাবলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু বাস্তবে এমন বস্তু মিলল না। দেখা যায় কালো রংয়ের বস্তু সবচেয়ে বেশি আলো তাপ শোষণ করতে পারে। কেন পারে?
আসলে কালো কোনো রং নয়। কালো মানে রংয়ের অভাব। কোনো বস্তুর ওপর আলো পড়লে সেই বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয় কিছু আলো। বাকি আলো শোষণ করে নেয় সেই বস্তু। কিন্তু দৃশ্যমান আলোক বর্ণালীর সব রংয়ের আলো সব বস্তু শোষণ করতে পারে না। গাছের পাতা সূর্যের সাদা আলো থেকে সবুজ বাদে সবকটা রংয়ের আলো শোষণ করে নেয়। কিন্তু সবুজ আলো শোষণ করতে পারে না। সবুজ আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে এসে পড়ে বলেই গাছের পাতা আমরা সবুজ দেখি। তেমনি শরীরের রক্ত লাল বাদে সব আলো শোষণ করে নেয় বলে রক্তের রং লাল।
এতো গেল দৃশ্যমান বর্ণালীর কথা। কিন্তু সে যেসব আলো দেখতে পাই না সেগুলো যদি প্রতিফলিত বা শোষিত হয়, তখন কী হয়?
বস্তুর রংয়ের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান আলো মূল ভূমিকা পালন করে। তাই অদৃশ্য আলো যেমন রেডিও তরঙ্গ, গামা রে ইত্যাদি বস্তুর স্বাভাবিক রংয়ের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। কিন্তু ওসব আলো নাইট ভিশণ চশমা দিয়ে অন্ধকারে দেখতে কাজে লাগে। শরীরের ভেতরের রোগ-ব্যাধির ছবি তুলতেও অদৃশ্য আলোর ভূমিকা বিরাট। কিন্তু সেসব আমাদের আলোচনা বিষয় নয়।
আবার ফিরে আসি কালো বস্তুতে। কালো বস্তু মূলত দৃশ্যমান আলোর প্রায় সবটুকুই শোষণ করে নেয়। তাই কোনো রং আমরা দেখতে পারি না। আর রংয়ের অভাবের কারণেই সেই বস্তুটার রং কালো। এখানে কিন্তু একটা ঘাপলা আছে। প্রশ্ন হতে পারেন, কালো বস্তু আলো প্রতিফলন যদি না-ই করবে, তা হলে তাকে আমরা দেখি কী করে?
আগেই বলেছি, কালো বস্তু দৃশ্যমান আলোর ‘প্রায় সবটুকুই’ শোষণ করে নেয়, কিন্তু ‘সবটুকু’ নয়।
কিন্তু বিজ্ঞানীদের তো ‘প্রায়ই’-এ মন ভর না। তারা একটা আদর্শ কালো বস্তু চাইলেন। যে বস্তু সব আলো শুষে নেবে। দৃশ্যমান অদৃশ্যমান সব। শুষে নেবে বিকির্ণ শক্তি ও তাপ। কিছু ফিরিয়ে দেবে না। কিন্তু এমন কালো বস্তুর সন্ধান মিলল না। সুতরাং কল্পিতই থেকে গেলো আদর্শ কালো বস্তু। বিজ্ঞানীরা যার নাম দিলেন ‘ব্ল্যাক বডি’। ভালো বাংলায় যাকে বলে আদর্শ কৃষ্ণবস্তু।
পৃথিবীতে যত কালো বস্তু আছে আদর্শ কৃষ্ণবস্তুর কাছাকাছি হলো কালো ভেলভেট। কিন্তু কালো ভেলভেটও আদর্শ কৃষ্ণ বস্তু নয়। সেও কিছুটা আলো ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু পদার্থ-বিজ্ঞানে ‘আদর্শ’ বিষয়টা বহু পুরোনো। প্রায় সবড়্গেত্রেই, কোনো না কোনো বস্তুকে বা মানকে আদর্শ ধরে নেওয়া হয়। যেমন, আদর্শ তাপমাত্রা, আদর্শ চাপ। মাপজোখের ক্ষেত্রে পানিকে আদর্শ বস্তু ধরে অনেক হিসাব-নিকাশ কষতে হয়। বিবিকিরণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও আদর্শ কৃষ্ণবস্তু অপরিহার্য হয়ে উঠল। তখন বিজ্ঞানীরা ভাবলেন তারা পরীক্ষাগারেই কৃষ্ণবস্তু তৈরি করবেন।
আদর্শ কৃষ্ণবস্তুর প্রথম ধারণা দেন বিজ্ঞানী গুস্তভ কার্শফ ১৮৬০ সালে। ১৮৯৫ সাল নাগাদ কৃষ্ণবস্তু তৈরি হয়। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের ওপর প্রথম একটা সূত্রটাও দিয়েছিলেন জার্মান পদার্থবিদ গুস্তভ কার্শফ। তিনি বলেন, কোনো বস্তুর তাপমাত্রা যদি পরিবেশের তাপমাত্রার চেয়ে কম হয়, সেই বস্তু নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘের বিকিরণ শোষণ করে নিজের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করবে। আবার কোনো বস্তুর তাপমাত্রা যদি পরিবেশের তাপমাত্রার চেয়ে বেশি হয় তবে সেই বস্তু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘের আলো বিকিরণ করে তরঙ্গদৈর্ঘ হ্রাস করবে।
তখনাকার বিজ্ঞানীরা জানতেন, কোনো বস্তুকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করতে থাকলে তার বিকিরণের পরিমাণটাও বাড়তে থাকে। সাথে সাথে বিকিরণের রংয়েরও পরিবর্তন ঘটে। একটা লোহাকে উত্তপ্ত করলে বিকিরণের ব্যপারটা স্বচোক্ষেদেখা সম্ভব।
লোহাকে উত্তপ্ত করলে প্রথমে লোহা শুধু গরমই হবে। রংয়ের কোনো পরিবর্তন হবে না। কিন্তু আরও উতপ্ত করলে তখন হালকা লাল রংয়ের আভা দেখা দেবে। তারমানে বিকিরণের রং পরিবর্তনের বিষয়টা তখন স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এখন যদি তাপমমাত্রা আরও বৃদ্ধি করা যায়? লোহার রং তখন গাঢ় লাল হয়ে উঠবে। তাপমাত্রা ৫০০ ডিগ্রির ওপরে উঠলেই কেবল লোহার রং লাল হবে। তাপাত্রা ৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলে গরম লোহা তখন ছড়াবে উজ্বল হলুদ দ্যূতি। তারমানে বিকিরণের তৈরঙ্গদৈর্ঘ্য কমছে। কারণ লালের চেয়ে হলুদ রংয়েল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম। লাল থেকে কিন্তু সরাসরি লোহার রং একবারেই হলুদ হয় না। ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পরে তাপমাত্রা ধীরে বাড়াতে একসময় কমলা রং দেখা যাবে।
৮০০ ডিগ্রি থেকে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকলে নিউটনের বর্ণালী বেনীআসহকলার বাকি রংগুলোও একে একে দেখা যাবে। সবুজ, আসমানী, নীল আর বেগুনি। তারপর লোহার তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে একসময় হবে সূর্য পৃষ্ঠের সমান। তখন সেই উতপ্ত লোহার রং উজ্জ্বল সাদা দেখাবে। কোনো বস্তুর তাপমাত্রা কতটা বাড়ালে কতটুকু কতটুকু তাপ কিংবা আলোকরশ্মি বিকিরণ করবে সেটা তুলনা করার জন্য একটা আদর্শ কৃষ্ণবস্তুর দরকার হয়ে পড়ে।
আদর্শ কৃষ্ণবস্তু তৈরি হলো। বিজ্ঞানীরা সেটা নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। লোহার টুকরোর মতো কৃষ্ণবস্তুকেও উত্তপ্ত করা হলো। ধরা যাক, ৭০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কৃষ্ণবস্তুকে উত্পত্ত করা হয়েছে। ওই তাপমাত্রায় কৃষ্ণবস্তুটি যে তাপমাত্রা ও আলোকরশ্মি বিকিরণ করবে তা অন্য যেকোনো বস্তুর চেয়ে বেশি। কারণ কোনো বস্তুই কৃষ্ণবস্তুর মতো শতভাভাগ তাপমাত্রা শোষণ করতে পারে না। তাই কোনো বস্তুর বিকীর্ণ তাপ ও আলো কৃষ্ণবস্তুর সমান হবে না। কিন্তু কোব নভোযানের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেলো সিএমবিআরের আচরণ হুবহু কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের মতো। কোব-এর ডাটা থেকে জানা গেল, যখন সিএমবির জন্ম হচ্ছে, তখন মহাবিশ্বের সকল ভরশক্তি সমসত্ত হারে ছড়িয়ে পড়ছে। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সবস্থানে ভরশক্তির ঘনত্ব সমান। তখন আরেকটা সমস্যা সামনে এসে পড়ল। তাই যদি হবে এখন মহাবিশ্বের সবজায়গায় ভরশক্তির ঘনত্ব সমান নয় কেন?
হ্যা, এখন মহাবিশ্বের কোথায় অতি নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ রয়েছে, কোথাও চরাচরজুড়ে শুধুই শূন্যতা। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভরশক্তির ঘনত্ব সব জায়গায় সমান নয়। কোথাও অত্যন্ত বেশি। কোথাও কোথাও শূন্যের কোঠায়? এমনটা হলো কীভাবে? এ প্রশ্নের সমাধানের জন্য পরে আরও অভিযান পরিচালনা করা হয় সিএমবিআরের রহস্য উন্মোচনের জন্য।
১৯৯২ সালে নতুন করে কোব নভোযান থেকে ডাটা সংগ্রহ করা হয়। সেই ডাটা আগের ডাটার চেয়ে পার্থক্য ধরা পড়ে। সেই পার্থক্যটাও কিন্তু খুব বেশি নয়। এক লক্ষভাগের একভাগ মাত্র। এটুকু পার্থক্যেরও গুরুত্ব অনেক। এই ডাটা পার্থক্য থেকেই বিজ্ঞানীরা অনেকটাই নিশ্চিত হলেন আসলেই ইনফ্লেশন ঘটেছিল। এই আবিষ্কারের জন্য কোব-এর দুই গবেষক জর্জ স্মুটার আর জন ম্যাথার ২০০৬ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন। সেই পর্যবেক্ষণ থেকে আরও জানা যায় ইনফ্লেশনের কারণেই মহাবিশ্বে গ্যালাক্সি, নক্ষত্র ইত্যাদির মতো বস্তুগুলো জন্ম নিতে পেরেছিল। আবার এই ইনফ্লেশনের কারণেই ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জিদের জন্ম।
আরও নিখুঁত ভাবে সিএমবিআরের হদিস করতে দুটো এক্সপেরিমেন্ট বিজ্ঞানীরা। একটার নাম ব্যুমেরাং এক্সপেরিমেন্ট। এটাতে কোনো নভোযান-টান ছিল না। এতে ব্যবহার করা হয় বিশাল আকারের একটা বেলুন। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় একটা শক্তিশালী টেলিস্কোপ। ১৯৯৭ সালে এটা উত্তর যক্তরাষ্ট্র থেকে প্রথম আকাশে পাঠানো হয়।
এরপর ১৯৯৮ আর ২০০৩ সালে আরও দুবার আকাশে উড়াল দেয়। মাটি থেকে ৪২ হাজার মিটার ওপরে উঠে এটা মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করে। এ থেকে পাওয়া যায় সিএমবিআর ডাটা। সেই ডাটা বিশ্লেষণ করে যে ফল পাওয়া যায় তা আগের অধ্যায়ে বর্ণিত সুাপারনোভা অুনসন্ধানকারীদের সঙ্গে মহাবিশ্বের চিত্রের মিল পাওয়া যায়। অর্থাত্ এই অনুসসন্ধানেও ডার্ক ম্যাটারের তত্ত্ব ভালোভাবেই টিকে থাকে। এর পর ম্যাক্সিমা নামে আরও দুটি বেলুন পর্যবেক্ষণ চালানো হয় ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে। সেই পর্যবেক্ষণেও মোটামুটি একই রকম ফল মেলে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।