জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবে কর্মী যাওয়ার ক্ষেত্রে সম্প্রতি বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশটিতে পাড়ি জমানোর অপেক্ষায় থাকা অর্ধলক্ষাধিক কর্মীর ভিসা, বিমান টিকিট ও অন্যান্য প্রসেসিং কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরও শুধু বিএমইটির বহির্গমন ছাড়পত্র না পাওয়ার কারণে তাদের বিদেশে যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিবাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সত্যায়ন জটিলতার কারণে এক মাসের ব্যবধানে শুধু সৌদি আরবেই ৫০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কম গিয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় আটকে পড়া অনেক কর্মীর ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে অথবা শেষ হচ্ছে বলে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে।
একক ভিসায় সৌদি আরবগামী কর্মীদের বাংলাদেশ দূতাবাসের সত্যায়ন নেয়া বাধ্যতামূলক করার কারণে মূলত শ্রমিক যাওয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন অভিবাসনসংশ্লিষ্টরা। যদিও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সৌদি আরবে কর্মী পাঠানো রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদেরকে এ নিয়ে পরিষ্কারভাবে বলে দিচ্ছেন, বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত সত্যায়ন না আনা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা (বিএমইটি) ওই সব কর্মীর নামে একটিও বহির্গমন ছাড়পত্র দেবেন না। অপর দিকে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা জোর দিয়ে বলছেন, সৌদি আরবের যেসব কোম্পানি থেকে তারা একক ভিসা সগ্রহ করছেন তারা দূর-দূরান্ত থেকে দুই-চারটা ভিসার জন্য দূতাবাসে যেতে চাচ্ছেন না। প্রয়োজনে তারা বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য দেয়া ভিসা অন্য দেশে দিয়ে দেবেন। রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা এমন অচলাবস্থার মধ্যে দাবি করে বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে সৌদি আরকের নিয়োগকর্তারা ক্ষুব্ধ হয়ে এসব একক ভিসা দেয়া বন্ধ করে দেবেন। এতে তাদের ক্ষতি হবে না। ক্ষতি হবে বাংলাদেশের। তাদের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজারটি সঙ্কুচিত হওয়ার পাশাপাশি অন্য দেশে চলে যাওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে।
গত সপ্তাহে ঢাকার ফকিরাপুল এলাকার এক জনশক্তি প্রেরণকারী ব্যবসায়ী নিজের নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, আমরা সৌদি আরব থেকে ভিসা কিনে আনছি। কর্মীর সবকিছু প্রসেসিং করার পর বিএমইটির (জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ) বহির্গমন শাখা থেকে ছাড়পত্র পাচ্ছি না। তারা বলছেন, কর্মীর ভিসা ঠিক আছে কি না, চুক্তি মোতাবেক কাজ, বেতন পাবে কি না সেগুলোর বিষয়ে সৌদি আরবের ব্যংলাদেশ দূতাবাস থেকে সত্যায়িত করে আনতে বলছে বিএমইটি। কিন্তু আমরা যে কফিলের কাছ থেকে একটা-দুইটা অথবা তিন-চারটা ভিসা কিনছি ওই সব কোম্পানি বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। তারা কোনোভাবেই দূতাবাসে সত্যায়ন করাতে হাজার মাইল দূর থেকে আসতে চায় না। প্রয়োজনে তারা এসব ভিসা অন্য দেশে বিক্রি করে দেবে তবুও বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে সত্যায়ন করাবে না। এখন আমাদের হয়েছে যত সমস্যা। এক প্রশ্নের উত্তরে ওই মালিক বলেন, আমরা কর্মীর যাবতীয় দায়িত্ব নিয়ে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে মুচলেকা দিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কর্মী পাঠাচ্ছি। যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে তো ওই কর্মীকে দেশে ফেরত আনা এবং ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদান করব। এরপরও বিএমইটি আমাদের কর্মীর বহির্গমন দিতে কী কারণে গড়িমসি করছে তা আমরা বুঝতে পারছি না।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার অফিসেই শতাধিক কর্মীর নামে ভিসা জমা হয়ে আছে। সবকিছু হওয়ার পরও তারা যেতে পারছে না। আমার জানা মতে, যারা সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোর ব্যবসা করছেন সবার মিলিয়ে কম করে হলেও ৫০ হাজারের বেশী শ্রমিকের বিদেশযাত্রা এখন আটকে আছে। এতে আমরা আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এসব শ্রমিক যেতে না পারলে ভবিষ্যতে একক ভিসাগুলো অন্য দেশে চলে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। শুধু একজন মালিক নন, এমন অসংখ্য মালিক প্রতিদিন সৌদি আরবগামী কর্মীদের বহির্গমন ছাড়পত্র করানোর জন্য বিএমইটির কর্মকর্তাদের হাত-পায়ে ধরছেন। দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন। এর আগে অবশ্য ২৮ ফেব্রুয়ারির আগের যতগুলো কর্মীর যাত্রা আটকে ছিল একই অভিযোগে সেগুলো এজেন্সির মালিকরা আন্দোলন করে ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন; কিন্তু এরপরে জমা পড়া ভিসার বিপরীতে আর কোনো ছাড়পত্র তারা বিএমইটি থেকে নিতে পারছেন না।
কাকরাইল রাজমণি কমপ্লেক্সের একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু বিএমইটি কর্তৃপক্ষ সেগুলোর ছাড়পত্র এখনো দিচ্ছে না। এখন আমাদের আবার আন্দোলন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখছি না। তারা বলছেন, আমরা একক ভিসার প্রতিটা কর্মীর বিপরীতে বিএমইটিতে মুচলেকা দিচ্ছি। লাইসেন্সের বিপরীতে জামানত আছে; কিন্তু তারপরও ‘এভাবে আমাদের কাজ আটকে রাখার কোনো মানে হয় না।’
তবে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কর্মকর্তারা বারবার রিক্রুটিং এজেন্সীর মালিকদের বিষয়টি বলার চেষ্টা করছেন, সৌদি আরবে একক ভিসায় যাওয়ার পর বহু শ্রমিক বিপদে পড়েছেন, অনেকেই প্রতারিত হয়েছেন। এর মধ্যে অনেকে কাজ না পেয়ে বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার আছেন জেলে। তারা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, সৌদি আরবে আড়াই হাজার কোম্পানি রয়েছে নামসর্বস্ব। তাদের কোনো অফিস পর্যন্ত নেই। এসব ভুয়া কোম্পানির নামে গিয়ে অনেক শ্রমিক ইতোমধ্যে সৌদি আরবে গিয়ে প্রতারিত হওয়া ছাড়াও নানা সমস্যায় পড়েছেন। এরপরই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, একক ভিসাধারীদের জন্য সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের সত্যায়ন আনতে হবে। না আনলে কোনো কর্মীকে বহির্গমন ছাড়পত্র দেয়া হবে না। এক প্রশ্নের উত্তরে ওই কর্মকর্তারা বলছেন, এজেন্সির মালিকরা যুক্তি দেখাচ্ছে, দূর-দূরান্ত থেকে নিয়োগকারী কোম্পানির মালিক (কফিল) আসতে পারবেন না। ঠিক আছে। তাদের বিষয়টি আমলে নিয়ে এখন নতুন নিয়ম আমরা চালু করেছি। সেটি হচ্ছে, ওই কোম্পানির মালিক শুধু তার কর্মী লাগবে এটা শুধু নির্দিষ্ট অ্যাপে (অনলাইন) কর্মী নেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে রেজিস্ট্রেশন করবেন। এরপর তাদের আর কোনো কাজ নেই। দূতাবাসে আসতে হবে না। এখন তারা সেটিও করতে গড়িমসি করছেন।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে বিএমইটির বহির্গমন শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, কর্মী দেশে ফেরত এলে তখন বিএমইটিকেই খেসারত দিতে হয়। বিদেশেও আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষণ্ণ হয়। তাই আমরা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারছি না। আমরা চাই বিদেশে গিয়ে কোনো শ্রমিক যাতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন।
বিএমইটির পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই চার মাসে মোট শ্রমিক গিয়েছেন দুই লাখ ৩০ হাজার ২৫৫ জন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে গিয়েছিলেন ৭৬ হাজার ৬১৮ জন। পরের মাসে সেটি কমে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ২৫৮ জনে। একক ভিসায় বহির্গমন ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক করার কারণে কমে যায় কর্মীর সংখ্যা। এজেন্সির মালিকরা আন্দোলন করে চাপ সৃষ্টি করলে মানবিক কারণে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ২৮ ফেব্রুয়ারির আগে আটকা পড়া কর্মীদের বহির্গমন ছাড়পত্র দেয়া হয়। এতে পরের মাসে অর্থাৎ মার্চ মাসে বেড়ে কর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮০ হাজার ৭০৮ জনে। এক মাসের ব্যবধানে আবারো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এপ্রিল মাসে কর্মী গিয়েছেন মাত্র ২৮ হাজার ৬৭২ জন। অর্থাৎ মার্চ মাস থেকে এপ্রিল মাসে ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মী কম গিয়েছেন বলে পরিসংখ্যানে উল্লেখ রয়েছে। সূত্র : নয়া দিগন্ত
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।