জুমবাংলা ডেস্ক : আলোচিত জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া আর নেই। আজ সোমবার (২৪ জুন) রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনি। জল্লাদ শাহজাহানের জন্ম নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে। তিনি মৃত হাছেন আলীর ছেলে। মায়ের নাম মেহের। তিন বোনের মধ্যে বর্তমানে এক বোন বেঁচে আছে।
শাহজাহান ভূঁইয়া। তিনিই জল্লাদ শাহজাহান। সেনাবাহিনীর চাকরিতে কর্মরত ছিলেন। হঠাৎ সেখান থেকে পালিয়ে এলেন। আইন ভঙ্গের অপরাধে তার সাজা হয়। এক বছর কারাভোগ করেন তিনি। কারাগারে ডাকাতি মামলার দুই আসামির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে। ডাকাতির সবকিছু রপ্ত করেন। সাজা শেষে কারাগার থেকে বের হন। শুরু হয় পরিবারের অবহেলা ও অর্থ সংকট।
ডিভোর্স হয় তার স্ত্রীর সঙ্গে। পরবর্তীতে জড়িয়ে পড়েন অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। ৬ শতাধিক ডাকাতি করেছেন তিনি। তার ৩৫টি হত্যা মামলা এবং একটি অস্ত্র মামলায় ১শ’ চুরাশি বছর সাজা হয়। পরে উচ্চ আদালতের বিশেষ বিবেচনায় ৪২ বছর কারাদণ্ড পান। টানা ৩২ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। তার হাতেই টেনেছেন ৬০ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির ফাঁসির দড়ি।
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন শাহজাহান। একসময় যুক্ত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। দায়িত্ব পালন করেন নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি হিসেবে। জেলে থাকা অবস্থায় পরিচিতি পান জল্লাদ হিসেবে। দীর্ঘ সময় কারাভোগের পর ২০২৩ সালের ১৮ই জুনে কারাগার থেকে মুক্তি পান। এই মানুষটি বর্তমানে একাকী বসবাস করছেন ঢাকার কেরানীগঞ্জে। নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলায় তার বাড়ি। তিনি মৃত হাছেন আলী ভূঁইয়ার সন্তান। ৩ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সে সবার ছোট। প্রথম জল্লাদ হিসেবে তার খাতায় নাম ওঠে ২০০১ সালে। শাহজাহান ভূঁইয়ার শৈশব, জেলজীবন, জল্লাদ শাহজাহান ছিল জল্লাদ জীবন’ নামের আত্মজীবনী প্রকাশ হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৪-এ। প্রকাশনা সংস্থা কিংবদন্তি পাবলিকেশন প্রকাশ করেছে বইটি।
প্রথম জেল জীবন: ১৯৮১ সালে জেল জীবনের শুরু। এর আগে যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। নানাবিধ কারণে ব্যারাক ছেড়ে চলে আসেন। অনুপস্থিতি হয়ে যাওয়ায় ওয়ারেন্ট জারি হয়। ব্যারাকে ফিরে আসার পর তাকে কোয়ার্টার গার্ডে রাখা হলো ৩ দিন। এরপর কোয়ার্টার গার্ড থেকে বের করে সেনাবাহিনীর অফিসার ইনচার্জ অস্থায়ী কোর্ট বসালেন। সেই কোর্টে রায় দিলেন, সেনাবাহিনীর আইন লঙ্ঘন করায় এক বছরের কারাদণ্ড হয়। তাকে সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে আমদানি ওয়ার্ডে রাখা হয়। এভাবে জেলে দীর্ঘদিন কেটে গেল। তখনো তার বাড়িতে জানতো না সে জেলে আছে। তাদের এই বিষয়ে কখনো চিঠিই লিখিনি। নিজের মতো করে জেল জীবন কাটাতে শুরু করলেন। জেলে প্রথম দিন পরিচয় হয়েছিল কফিলউদ্দিন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তার কাছ থেকে ডাকাতির সবকিছু শুনলেন। এরপরে পরিচয় হয় গিয়াসউদ্দিন নামে অপর এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনিও ছিলেন ডাকাতি মামলার আসামি। তার সঙ্গে কফিলউদ্দিনের আগে থেকে পরিচয় ছিল। জেলে থাকতেই বুঝে গিয়েছিলেন তার চাকরি আর থাকবে না। তাই জেল থেকে বের হয়েই কফিলুদ্দিনের সঙ্গে ডাকাতি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাদের এই বিষয়ে আগে থেকেই বলে রাখলেন শাহজাহান। তারাও তাকে নিতে রাজি হলো, কারণ তারা জানতো সে সেনাবাহিনীর ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তাকে নিলে তাদের সুবিধা হবে। ১০ মাস পরেই শাহাজাহানকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হলো।
পরিবারের অবহেলা: জেল থেকে বের হয়ে সবকিছু নিয়ে সোজা বাড়িতে যান। বাড়িতে তখনো কেউ জানে না যে তিনি জেল খেটেছেন। তবে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আস্তে আস্তে সব জানতে পেরেছিল। শাহজাহানের স্ত্রী এক বছর তাকে চিঠি লিখেছেন কিন্তু কোনো জবাব পায়নি। তাই সে এই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। শ্বশুরবাড়িতে জানাজানি হওয়ার পর তাকে খারাপ চোখে দেখা শুরু করলো। আর চাকরি ছেড়ে আসায় তার বাবাও তার প্রতি রেগেছিল। যেহেতু তার স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে পারছিলেন না। পরে দু-পক্ষের সম্মতিতে তালাক হয়ে যায় শাহজাহান ও তার স্ত্রীর। এরপর শুরু হয় শাহজাহানের ভবঘুরে জীবন-যাপন। আর্থিক সংকটের কারণে হতাশা আর কষ্টে ভুগতে থাকেন। তার বাবাও কখনো টাকা পয়সা দিতেন না। ধীরে ধীরে তার মধ্যে একটা জেদ বাসা বাঁধতে থাকলো। বাড়ির কাজে আনা ১০টা টিনের শীট বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দিলেন। এই টাকা দিয়ে কিছুদিন চললেন। দিন যত যায় তার জীবনও তত কঠিন হতে থাকে।
অপরাধের শুরু: কোনো উপায় না পেয়ে এলাকার চেয়ারম্যানের বাড়িতে গৃহস্থালীর কাজ শুরু করলেন। সেখানে ৩ মাস কাটলো। সুবিধা না হওয়ায় কাজটি ছেড়ে দিলেন। এভাবে একদিন ঘুরতে ঘুরতে দেখা হলো সেই ফাইজুদ্দিনের সঙ্গে। তাকে সবকিছু বললেন। সে রাতে শাহজাহানকে দেখা করতে বললো। তার কথায় আস্বস্ত হয়ে তার বাড়িতে গেলেন। তাকে বসিয়ে রেখে ফাইজুদ্দিন প্রস্তুতি নিতে নিতে বললো, চল ডাকাতি করি। শাহজাহান আর না করলো না। ফাইজুদ্দিনের বাড়ি থেকে বের হয়ে কাছেই একটা জঙ্গলে চলে গেলেন। সেখানে তার পরিচিত আরও কিছু লোক একত্রিত হয়ে পরিকল্পনা করে নিলো। এরপর সবাই মিলে রওয়ানা দিলো বড়গাঁও এলাকায়। ফাইজুদ্দিন শাহজাহানের হাতে একটা বড় ছুরি ধরিয়ে দিলো। বাকিদের হাতে ছিল বড় বড় রামদা, চাপাতি। বাড়ির সামনে এসে তাকে বললো সে যেন উঠানে দাঁড়িয়ে পাহারা দেয়। বাকিরা ঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেল। ঘরে ঢুকে তারা যা সামনে পেলো টাকা পয়সা, গহনা, সব নিয়ে বাইরে চলে আসলো। প্রথম ডাকাতির পর ফাইজুদ্দিন তাকে ৬শ’ টাকা দিলো। সেটা দিয়ে তার বেশ কিছুদিন খুব ভালোভাবে চললো। এরমধ্যে হাতের টাকা পয়সা শেষ হয়ে গেল। কয়েকদিন পর ফাইজুদ্দিন আবার খবর দিলো গাজীপুরের ভাওয়াল এলাকায় বড় একটা ডাকাতি আছে। তার জন্য লোক লাগবে। শাহজাহান যেন সময়মতো রেডি থাকে। এবারো তার হাতে ছুরি দিয়ে বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে রেখে তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেল। এরপর এক একটা দল এক একটা ঘরের দরজা ভেঙে লুট করতে শুরু করলো। ডাকাতি শেষে আবার নির্জন এলাকায় ঢুকে গেল। সেবার শাহজাহান হাতে পেলেন ৯শ’ টাকা। এরমধ্যে জেলখানায় পরিচয় হওয়া গিয়াসউদ্দিন ছাড়া পেয়েছে। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে ডাকাতি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবে তিনি ধীরে ধীরে গিয়াসউদ্দিনের দলের পাকা সদস্য হয়ে উঠলেন। একদিন ডাকাতি করতে গেলেন বাড়ি থেকে পনেরো মাইল দূরে। ডাকাতি করে বের হওয়ার পর দেখলেন গ্রামের মানুষ তাদের ঘিরে ধরেছে। ভয় দেখাতে তখন স্টেনগান নিচু করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়লেন। সেই গুলি দু-একজনের পায়েও লাগলো। চোখের সামনে তারা মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। গুলির শব্দ শুনে সবাই জান বাঁচাতে শুরু করলো ছোটাছুটি। তাদের দলও সুযোগ বুঝে সেখান থেকে বের হয়ে গেলেন। এভাবে যতই দিন যাচ্ছে, ডাকাত হিসেবে তার সাহস ও শক্তি ততই বাড়ছিল। বাড়িতে তার বাবা না জানলেও মা জানতে পেরেছিলেন সে ডাকাতি করে। তবে তিনি কিছু বলতেন না। শাহজাহানের বোনেরাও ধীরে ধীরে সব জানতে পেরেছিল। একসময় সবকিছু ছেড়ে ঢাকায় চলে এলেন শাহাজাহান। ঢাকায় এসে বাসা নিলেন মুগদা এলাকায়। সেখানে থেকে নিয়মিত ডাকাতি করতেন। যুক্ত হলেন নতুন দলে। যারা বাসে বাসে ঘুরে ডাকাতি করতো। রাস্তার একটা ফাঁকা জায়গায় বাস, মাইক্রোবাস থামিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা, ঘড়ি, আংটি, গহনা যা পেতেন সব নিয়ে নিতেন।
ডাকাতি, অস্ত্র এবং হত্যা মামলা: একদিন ১৭ জন মিলে একটি বাস থামিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা, পয়সা ঘড়িসহ সব রেখে দিল। পুলিশের কাছে খবর গেলেও জানের ভয়ে কোনো পুলিশ ঘটনাস্থলে আসেনি। সাধারণ মানুষও কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায়নি। এরপর একটার পর একটা ডাকাতির মিশন শুরু হয়। শেষ ডাকাতি করেছিলেন ১৯৯১ সালে। এ সময় বাসে ডাকাতি করতে গিয়ে চালকের মাথায় রিভালবার ঠেকিয়ে আছে শাহজাহান। এমন সময় ড্রাইভারের সামনের লুকিংগ্লাসে খেয়াল করলেন কেউ একজন তাকে ধরতে আসছে। বেশ ভুষা দেখে সেনাবাহিনীর লোক মনে হলো। তাকে ভয় দেখাতে রিভলবার দিয়ে একটা আঘাত করলেন তিনি। তখনই রিভলবারের ম্যগাজিন খুলে পড়ে। চালক বুঝতে পেরেছিল সে আর গুলি চালাতে পারবে না। সামনে একটা পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। চালক গাড়ির গতি বাড়িয়ে সোজা সেই পুলিশ ফাঁড়ির দিকে নিয়ে যেতে থাকলো। গাড়ির গতি দেখে দলে থাকা হাশেমের মেজাজ গরম হয়ে গেল। সে তার হাতে থাকা ছুরি দিয়ে চালকের পিঠে ঢুকিয়ে দিলো। ধারালো ছুরি পিঠ ভেদ করে ফুসফুস কেটে সামনে দিয়ে বের হয়ে গেল। এ সময় চালক কোনোভাবে বাস পুলিশ ফাঁড়ির কাছে নিয়ে পৌঁছালো। বিপদ টের পেয়ে সবাই গাড়ির জানালা দিয়ে যে যার মতো নেমে পালাতে লাগলো। তবে দলের দুজন পুলিশের হাতে ধরা পড়লো। শাহজাহান রিভলবার ফেলে দিয়ে যাত্রী হওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসা করলো। এই ঘটনায় তাকে প্রধান আসামি করে ডাকাতি, অস্ত্র এবং হত্যা মামলা করা হলো। মানিকগঞ্জ জেলখানায় রাখা হলো তাকে। মামলা কোর্টে ওঠার পর জজ সাহেব তাকে অস্ত্র মামলায় ১২ বছরের সাজা দেন। হত্যাকাণ্ডের মামলায় ৩০ বছর, আর অস্ত্র মামলায় ১২ বছর। মোট বিয়াল্লিশ বছরের সাজা তাকে ভোগ করতে হবে।
জীবনের অনুশোচনা: প্রথমবার জেলে যাওয়া আর শেষবার জেল থেকে বের হয়ে আসার মধ্যে বিয়াল্লিশ বছরের ব্যবধান। শাহজাহানের জীবনের বড় একটা সময় কেটেছে চৌদ্দ সিকের ভেতরে। জেলের মধ্যে বসেই বাবা মারা যাওয়ার সংবাদ পেয়েছেন তিনি। জেলে যাওয়ার পর তার বাবা কোনোদিন দেখতে আসেননি। বাবার মৃত্যুর সংবাদ দিতে তার মা এসেছিলেন। সেবার দেখা করে তার মা বলেছিলেন, ‘এটাই হয়তো আমাদের শেষ দেখা, তোর সঙ্গে আর দেখা করতে আসতে পারমু না।’ তার মায়ের কথা সত্যি হয়েছিল। দেখা হওয়ার কিছুদিন পরই তার মায়ের মৃত্যুর সংবাদ আসে তার কাছে।
জল্লাদ শাহজাহান বলেন, একজীবনে আমার নিজের বলতে যারা ছিল, তাদের বেশিরভাগকেই হারিয়ে ফেলেছি ততদিনে। শুধু বড় বোন ফিরোজা বেগম বেঁচে আছেন। জেল থেকে বের হওয়ার সময় আমাকে মুক্ত বিহঙ্গ মনে হলো। মনে হলো এতদিনে আমার ডানায় কেউ শিকল পরিয়ে রেখেছিল। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে পাওয়া টাকায় আমি কেরানীগঞ্জের গোলাম বাজারে একটি চায়ের দোকান দিয়েছি। কারণ বাকিটা জীবন কিছু না কিছু একটা কাজ করে যেতে হবে। শেষ জীবনে এসে আফসোস হচ্ছে, ইশ যদি বাবা-মায়ের কথা মেনে চলতাম, যদি সেনাবাহিনীর চাকরিটা ছেড়ে না আসতাম। যদি আরেকটু সহ্য করে থাকতাম, যদি বাবা-মায়ের সঙ্গে বেয়াদবি না করতাম। জীবনটা তাহলে অন্যরকম হতে পারতো। হয়তো আমারো একটা পরিবার হতো, হয়তো আমারো একটা সুখের জীবন হতো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।