জুমবাংলা ডেস্ক : চার দশক পর দেশের আকাশসীমায় নজরদারির স্ক্ষমতা বাড়াতে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বসছে নতুন রেডার। প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও এখন সেই রেডার দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে দেশের আকাশসীমায় নজরদারি করা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকাও চলে এসেছে আধুনিক এই রেডারের আওতায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন রেডার ব্যবস্থাটি পুরোপুরি চালু হলে বাংলাদেশের আকাশসীমায় নজরদারি আরও সহজ, দ্রুত এবং নির্ভুল হবে। পাশাপাশি ‘ওভার ফ্লাইং’ ফি হিসেবে বিপুল অর্থও আয় করাও সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, শাহজালালে রেডার স্থাপনের কাজ প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন যে রেডারটি স্থাপন করা হয়েছে, এটি পুরোপুরি ফাংশনাল হতে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।
বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা গেছে, নতুন রেডার স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। পাশাপাশি শাহজালালে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) টাওয়ার ও অপারেশন বিল্ডিংয়ের চলমান কাজও শেষের পথে।
তবে এই রেডার ও নেভিগেশনের পুরো সুবিধা পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু সময়। রেডারের কাজের সঙ্গে অটোমেশনসহ আরও কিছু কাজ বাকি রয়েছে, সেগুলো শেষ করতে চলতি বছরের শেষ সময় পর্যন্ত লেগে যাবে।
প্রকল্পের লজিস্টিকস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের থালেস। কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধি অ্যারোনেস ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ লিমিটেড।
অ্যারোনেসের কর্ণধার মাহবুবুল আনাম বলেন, “নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। বিশ্বের অত্যাধুনিক এই রেডার সিস্টেমে রয়েছে হেলমেট, এডি, এসবি ও মাল্টিলেটারেশনের মতো সুবিধা- যা উড়োজাহাজের নিখুঁত অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম। ঢাকা থেকে ২৮০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত দূরের আকাশসীমায় সবধরনের আকাশযানের অবস্থান ও গতিপ্রকৃতির নির্ভুল চিত্র ধরা পড়বে।”
নতুন রেডার বসানোর প্রক্রিয়া
বেবিচক জানিয়েছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৪৪ বছর আগে ১৯৮০ সালে যে রেডার বসানো হয়েছিল সেটি বদলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৫ সালে। এরপর ২০১২ সালে একটি কোম্পানি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় রেডার স্থাপনে ৩৩০ কোটি টাকার প্রাথমিক প্রস্তাব দেয়। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি পিপিপিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অনুমোদন দেয়।
অনুমোদনের ভিত্তিতে ২০১৫ সালে প্রকল্পের জন্য দরপত্র ডাকা হলে চারটি কোম্পানি অংশ নেয়। এরপর যাচাই-বাছাই শেষে ঠিকাদার কোম্পানি ‘করিম অ্যাসোসিয়েটসকে’ প্রাথমিকভাবে মনোনীত করে বেবিচক।
কিন্তু কিছু ‘অনিয়মের অভিযোগে’ করিম অ্যাসোসিয়টসের নামে ‘বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ায়’ শেষ পর্যন্ত সে উদ্যোগটি বাতিল হয়ে যায়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ উদ্যোগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে জিটুজি পদ্ধতিতে রেডার বসানোর সিদ্ধান্ত নেন।
২০২১ সালের এপ্রিলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সিএনএস-এটিএম (কমিউনিকেশন, নেভিগেশন অ্যান্ড সার্ভেইল্যান্স-এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট) ব্যবস্থাসহ রেডার স্থাপন নামে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার।
২০২১ সালের ৮ জুন ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি প্রকল্পটি অনুমোদন করে। আর প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা। এই ব্যয় বেবিচকের নিজস্ব তহবিল থেকে বহন করা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ফ্রান্সের কোম্পানি থালেসের সঙ্গে ২০২১ সালের অক্টোবরে চুক্তি করে বেবিচক।
চুক্তি অনুযায়ী, পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে রেডার স্থাপনের কাজ শেষ করতে হবে। অত্যাধুনিক এই রেডার পরিচালনার জন্য বেবিচকের কর্মকর্তাদের থালেসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নতুন রেডারে মিলবে যেসব সুবধা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শাহজালালের আধুনিক রেডার ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু হলে উড়োজাহাজ চলাচল আরও নিরাপদ হবে। আর পুরো দেশের আকাশসীমা নজরদারিতে আসায় দেশে অবতরণ না করে যেসব উড়োজাহাজ বাংলাদেশের আকাশ ব্যবহার করে, সেগুলো থেকেও ফি আদায় করা যাবে; ফলে দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
বেবিচকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান রেডার ও নেভিগেশন ব্যবস্থা প্রায় ৪৪ বছরের পুরনো হওয়ায় বঙ্গোপসাগরের বড় একটি অংশের পাশাপাশি দেশের পুরো আকাশ নজরদারি করা সম্ভব হয় না।
এতে ওভার ফ্লাইং ফি পুরোপুরি আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ একবার আকাশ ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, ওভার ফ্লাইং ফি প্রায় ৫০০ ডলার।
উড়োজাহাজ ট্রাফিক নজরাদারি বিষয়ক অ্যাপ ফ্লাইট রেডারের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করে প্রতিদিন ভারতের অভ্যন্তরীণ রুটের ৯০ থেকে ১০০টি ফ্লাইট চলছে। এভিয়েশনের ভাষায় একে ‘ওভার ফ্লাই’ বলে। দিনদিন ভারতের ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ছে।
মূলত ভারতের কলকাতা, শিলং, মনিপুর (ইম্পাল বিমানবন্দর), গুয়াহাটি ও আগরতলার ফ্লাইটগুলো বাংলাদেশের আকাশ ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের আকাশ ব্যবহার না করলে গন্তব্যে পৌঁছাতে তাদের দুই থেকে তিনগুণ অতিরিক্ত সময় লাগত।
ভারতের কলকাতা থেকে গ্যাংটক, শিলং ও আসামের সড়কপথ ব্যবহার করে গুয়াহাটির দূরত্ব দাঁড়ায় প্রায় ১০১৮ কিলোমিটার। এই পথ পাড়ি দিতে সময় লাগার কথা আড়াই ঘণ্টার মত। বাংলাদেশের আকাশ ব্যবহার করে এ রুটে মাত্র সোয়া এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টায় গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে ভারতীয় উড়োজাহাজ।
বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাওয়ায় তাদের আকাশপথের দূরত্ব দাঁড়াচ্ছে ৫১৯ কিলোমিটার। এ রুটে প্রতিদিন স্পাইস জেটের তিনটি ফ্লাইট, ইন্ডিগো এয়ারের ১০টি, এয়ার ইন্ডিয়ার সাতটি, ভিস্তারা এয়ারলাইন্সের পাঁচটি, গো ফার্স্ট এয়ারলাইনসের চারটি এবং এয়ার এশিয়া ইন্ডিয়ার দুটি ফ্লাইট চলাচল করছে।
এছাড়া কলকাতা থেকে ভারতের আগরতলার দূরত্ব ১ হাজার ৫৪৭ কিলোমিটার। কিন্তু বাংলাদেশের আকাশ ব্যবহারের ফলে দূরত্ব দাঁড়িয়েছে ৩৩০ কিলোমিটার। এ রুটে প্রতিদিন ইন্ডিগো এয়ারের সাতটি ও এয়ার ইন্ডিয়ার দুটি ফ্লাইট চলাচল করছে।
অন্যদিকে কলকাতা থেকে মনিপুরের রাজধানী ইম্ফলে প্রতিদিন এয়ার ইন্ডিয়ার আটটি, ইন্ডিগো এয়ারের সাতটি, এয়ার এশিয়া ইন্ডিয়ার দুটি ফ্লাইট চলছে। ১৫০৭ কিলোমিটারের এ রুটে অর্ধেকেরও কম অর্থাৎ মাত্র ৬২০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েই ফ্লাইটগুলো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে।
এতদিন পূর্ণাঙ্গ রেডার ব্যবস্থা না থাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকির পাশাপাশি আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ।
বেবিচকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান বলেন, “পুরোপুরি ফাংশনাল হতে সময় লাগলেও ইতোমধ্যে এই রেডারের ডেটা ব্যবহার শুরু হয়েছে। শুধু ঢাকায় এ রেডার স্থাপন করা হচ্ছে, তা না। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামে যে রেডার আছে, সেটারও আধুনিকায়ন হচ্ছে।”
সারাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে কমিউনিকেশন সেন্সর বসানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এর ফলে নিরাপদ উড্ডয়ন যেমন সহজ হবে, তেমনি রাজস্ব আয় বাড়বে সরকারের। এই সেন্সরগুলো স্থাপনের ফলে কমিউনিকেশন এবং সারভেইলেন্স (নজরদারি) দুটোই করা যাবে।”
তিনি বলেন, প্রতিটি রেডারে দুটি মোড থাকে। পুরোনো রেডারটিতে শুধু একটি মোড কাজ করত, প্রাইমারি মোড। নতুন এই রেডারে সেটি দূর হবে। এখানে সেকন্ডারি মোডও কাজ করবে। ফলে যে কোনো এয়ারপোর্ট থেকেই অন্য এয়ারপোর্টগুলোর এয়ার ট্রাফিক, উড্ডয়ন-অবতরণ সবকিছুই দেখা যাবে। মোট কথা পুরো নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাবে।
“ফ্রান্স থেকে রেডারের টাওয়ার স্থাপনের স্টিল স্ট্রাকচার এনে দাঁড় করানো হয়েছে। এটিসি টাওয়ার এবং অপারেশন বিল্ডিংয়ের কাজও শেষ। তবে এখনো বেবিচকের কাছে রেডার টাওয়ার হস্তান্তর করা হয়নি। সম্পূর্ণ কাজ শেষে বুঝে নিতে আরও কিছু সময় লাগবে।”
বেবিচক সদস্য (এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট) এয়ার কমডোর এ কে এম জিয়াউল হক বলেন, “আমরা আসলে শুধু রেডার নয়, পুরো একটা সিস্টেম স্থাপন করেছি। ইতোমধ্যে রেডার স্থাপন পুরোপুরি সম্পন্ন হয়েছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি বা মার্চের দিকে বেবিচকের কাছে এটি স্থানান্তরের কথা রয়েছে।”
কমবে নিরাপত্তা ঝুঁকি
পুরনো রেডার দিয়ে আকাশপথে নজরদারি চালাতে হিমশিম খেতে হয় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারকে। তাছাড়া সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু অঞ্চল এবং বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আসা বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ নতুন এলাকা এর আওতার বাইরে থাকায় এসব এলাকার ওপর দিয়ে আকাশযান উড়ে গেলে তা জানতে পারছিল না বাংলাদেশ।
সারাবিশ্বে এখন ড্রোন দিয়ে অন্য দেশের ওপর নজরদারির প্রবণতা বাড়ছে। শাহজালালে থাকা রেডারটি পুরনো প্রযুক্তির হওয়ায় দেশের আকাশসীমায় নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া কোনো আকাশযান বা ড্রোন শনাক্ত করা যাচ্ছিল না।
এতে দেশের নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন বাস্তবতায় বসানো হয়েছে ফ্রান্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থালেসের অত্যাধুনিক রেডার।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা বোর্ডের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, “দেশে এখন যে রেডারটি আছে, সেটি অনেক পুরনো। যেহেতু প্রযুক্তি আপডেট হয়েছে, আমাদের আকাশসীমার পরিধিও বেড়েছে…এটি (নতুন রেডার বসানো) ভালো সিদ্ধান্ত।
“এখন এই রেডার পুরোপুরি চালু হলে উড়োজাহাজ চলাচলে নিরাপত্তা ঝুঁকি কমবে, পাশাপাশি নজরদারি সীমা বাড়ায় সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।”
আরেক এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, “নতুন এই রেডার স্থাপনের ফলে আমাদের সেইফটি মেজারমেন্ট ভালো হবে। এতে উড়োজাহাজ চলাচলে নিরাপত্তা বাড়বে। আমরা আগে যেভাবে ইনফরমেশন পেতাম, তার চেয়ে সঠিক ও নির্ভুলভাবে এখন তথ্য পাওয়া যাবে। আগের রেডারটিতে শুধু প্রাইমারি ইনফরমেশন পাওয়া গেলেও, এখন সেকন্ডারি ইনফরমেশনও পাওয়া যাবে।”
তবে ল্যান্ডিংয়ের সময় রেডারের সুবিধা পুরোপুরি পেতে হলে বিমানবন্দরে ইন্সট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেমকে (আইএলএস) ক্যাটাগরি ১ থেকে ২-এ উন্নীত করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।