জুমবাংলা ডেস্ক : বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর বাবুবাজার ব্রিজ পার হলেই কেরানীগঞ্জ। নদীর ওপারে কিছুটা পথ এগোলেই গোলামবাজার। এই পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক ছিল। শুধু আমাদের সঙ্গে নেই হোল্ডিং নাম্বার। এই জাদুর শহরে সড়ক আর বাড়ির নম্বর ছাড়া কাউকে খুঁজে বের করা কঠিন। গায়ে গায়ে ঠাসা উঁচু-নিচু দালানের ফাঁকফোকরে আমরা বড় মসজিদের মিনার খুঁজতে থাকলাম।
সেই মিনারের সূত্র ধরেই সন্ধান পেলাম জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়ার চায়ের দোকানের। মহল্লার লোকজন এক নামেই চেনেন তাকে। যিনি বছরের পর বছর সারা দেশের জেলখানাগুলোতে রাজত্ব করেছেন। তার হাতে ফাঁসিতে ঝুলেছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অনেক আসামি। এদের মধ্যে রয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত কাদের মোল্লা থেকে সাকা চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর খুনিরাও তার সামনে ছিল অসহায়। ভয়ে কাঁপত সাধারণ কয়েদিরা। সেই জল্লাদ এখন চায়ের দোকানদার।
শাহজাহানের চায়ের দোকানে এখনো লেগে আছে নতুন কাঠ, রং আর আসবাবের ঘ্রাণ। কয়েকজন রাজমিস্ত্রি কাজের বিরতিতে চা পানে এসেছেন। শাহজাহান ব্যস্ত চা বানানোর কাজে। রং চা, গাভীর দুধের চা, কনডেন্স মিল্ক এই তিন ধরনের চা পাওয়া যায় এখানে। বেশ যত্ন নিয়ে চা বানিয়ে একটা কাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, কী করব বলেন। পেট তো চালাইতে হবে?
কথা বলার ফাঁকে একের পর এক চা বানিয়ে যাচ্ছেন শাহজাহান। কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পারলাম লোকে এখানে যতটা না চা পান করতে আসে তার চেয়ে বেশি আসে জল্লাদ দর্শনে। চা পর্ব শেষ করে কেউ ছবি তুলে, কেউ সেলফি তুলে নেন হাসিমুখে। এসবে এখন অভ্যস্ত শাহজাহান। তবে সবাই যে খুশি বিষয়টা তেমনও না। কেউ কেউ আছেন ঘোর বিরোধী। অনেক প্রতিবেশী তাকে পছন্দ করেন না। চুলার আগুন বাড়িয়ে দিয়ে শাহজাহান বলেন, ‘আমি জল্লাদ। মানুষ ফাঁসি দিয়া মারছি। এটা অনেকে সহজভাবে নিতে পারে না। কিন্তু এখানে আমার কী করার ছিল বলেন। আমি তো কেবল সরকারের হুকুমের গোলাম ছিলাম। সব ছেড়ে দিয়ে আমি এখন সাধারণ মানুষ। এটাই মানতে চায় না অনেকে। ঝামেলা করার চেষ্টা করে।’
এরই ভেতর মহল্লার আরও বেশ কয়েকজন তরুণ এসে হাজির শাহজাহানের চায়ের দোকানে। বেশ উৎসাহ নিয়ে চায়ের অর্ডার করলে তারা। চা বানাতে ব্যস্ত শাহজাহানের সঙ্গে কাজের ফাঁকফোকরেই আলাপ চলতে থাকে। প্রশ্ন জাগে মনে, দুনিয়ার এত এত কাজ থাকতে চা বানানোর কাজ কেন? একগাল হাসলেন শাহজাহান। তারপর আরাম করে একটা সিগারেট ধরালেন। কিছুটা চুপ থেকে বললেন, ‘ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকেই চা খাওয়া শিখেছি। মাটিতে পাটি বিছাইয়া চা-মুড়ি সামনে রাইখা বসাইয়া রাখত। সেই যে চা খাওয়ার অভ্যাস হইছে, সেটা আর ভুলতে পারি না। বলতে পারেন চা আমার নেশা। এই নেশাটাও জেল জীবনে তৈরি। জেলে চা না খাইলে আমার ঘুম আসত না। মাথার কাছে একটা চায়ের কেটলি রাখতাম। যেন ঘুম ভাঙলেই চা খাইতে পারি। যেদিন চা খাইতে না পারতাম, সারাটা দিন আমার মাথা ব্যথা করত। আমি চা বানাইতে ভালো পারি। তাই চায়ের দোকান নিয়া বসছি। নিজে খাইলাম অন্যদেরও খাওয়ালাম। এই চিন্তা থেকেই চায়ের দোকানি হইলাম।’
তবে স্বল্প পুঁজির কারণে নিজের চায়ের ব্যবসাটা জমজমাট করতে পারছেন না শাহজাহান। সবাই যেন তার দোকানে গিয়ে চা পান করেন সেই দাওয়াতও তিনি দিয়ে বেড়ান। ভুলে থাকতে চান জল্লাদ জীবন। অবসরে মান্না দে, ভূপেন, কিশোর কুমার, হেমন্তর গানই তার সঙ্গী। জীবনের এই পড়তি সন্ধ্যায় নতুন কোনো মায়ার বাঁধনে আর নিজেকে বাঁধতে চান না। চিরকুমার থেকেই মরতে চান। বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে চান নিজের মতো করে। কোনো প্রলোভনেই আর ভাসাতে চান না নিজেকে।
চা পানের এক ফাঁকে শাহজাহান জানান, ১৯৯২ সালের ৮ নভেম্বর ডাকাতির জন্য ১২ বছর এবং ১৯৯৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর অন্য একটি মামলায় ডাকাতি ও হত্যার ঘটনায় ৩০ বছরের কারাদণ্ড হয় কমিউনিস্ট পার্টির নরসিংদী জেলা শাখার এই সাবেক সভাপতির। কারাবিধি অনুযায়ী, আচার-আচরণ এবং অন্যান্য কারণে সব মিলিয়ে ১০ বছর ৫ মাস রেয়াত পেয়ে সাজা খেটেছেন ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।