শফিকুল ইসলাম খোকন : সারিবদ্ধভাবে বসে আছেন কয়েকজন নারী, হঠাৎ তাকালে বোঝা যাবে না তারা মাছ বাছাই করছেন। ভোরের আলো ফোটার আগে থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে মাছ বাছাই।
দেশের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রসহ পাথরঘাটা উপকূলের জেলে পল্লীতে এমন ব্যস্ততা চোখে পড়ে প্রতিনিয়ত।
শীত আর গরম উপেক্ষা করে মাছ ধরা থেকে শুরু করে খেয়ে না খেয়ে পেটের দায়ে কাজ করতে হয় তাদের। পেটে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর, হাঁচি, কাশি ও ত্বকের নানা রোগের ঝূঁকি থাকলেও করার কিছুই নেই, এ কাজ না করলে মুখে ভাত উঠবে না। এমন চিত্র উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটার একাধিক মৎস্য পল্লীর।
দারিদ্রের যাতাকলে নিষ্পেষিত নারীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও তাদের দিকে কেউ খেয়াল রাখে না।
এতো কষ্ট করে তারা যে পারিশ্রমিক পান, তা শুনলে চমকে উঠবে যে কেউ। মাছ বাছাইয়ের জন্য এসব নারীদের মজুরি দেওয়া হচ্ছে চিংড়ির মাথা। কখনো কখনো দেওয়া হয় কেজি প্রতি ১০ টাকা করে। চিংড়ির মাথা বা কখনো কিছু মাছ পেলে, তা বিক্রি করেন তারা।
এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে নারীর স্বাস্থ্য ও জীবন-জীবিকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
উপকূলের নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রেখে কীভাবে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
জাতিসংঘ ২০২৩ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’। এতে টেকসই উন্নয়নে জেন্ডার সমতা, উদ্ভাবনের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে উপকূলে লিঙ্গ সমতা তো দূরের কথা, এখনো নারীদের স্বাস্থ্য অধিকারই নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বরং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির কারণে নারী স্বাস্থ্যর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছেই।
কয়েক দশকে পাথরঘাটা উপজেলায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাসিন্দারা ভূমিহীন হওয়ায় দারিদ্র্য যেমন বাড়ছে, তেমনি এলাকায় সুপেয় পানির সংকট এবং পানির লবণাক্ততা বেড়েই চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে যে উষ্ণায়ন, পরিবেশের বিপন্নতার প্রভাব পড়ে নারীসহ সবার ওপর। পানির স্তর নিচে নেমে যায়, নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, নদী শুকিয়ে যায়। তখন দুই-একটি নলকূপে, যেখানে মিষ্টি পানি ওঠে, সেখানেও পানির জন্য হাহাকার। দীর্ষ পথ হেঁটে গিয়ে সেসব নলকূপের সামনে পানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয় নারীদেরই।
কথা হয় দেশের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মাছ বাছাই কাজে নিয়োজিত একাধিক নারীর সঙ্গে। তারা চিংড়ির মাথা রেখে বাকি অংশ বাছাই করে প্যাকেট করেন। সেসব প্যাকেট করা চিংড়ি পরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। মূলত নারীরাই এ কাজটি করে থাকেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারীরা মাছ বাছাই করেন। সুনির্দিষ্ট হিসাব না থাকলেও পাথরঘাটার উপকূলে অসংখ্য নারী শ্রমিক মাছ বাছাই, মাছ শুকানো, মাছ ধরাসহ নানা কাজে নিয়োজিত। আজ তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
মাছ বাছাইয়ে নিয়োজিত রেহেনা বেগম, সাহিদা বেগম, রেক্সনা বেগম বলেন, সকাল থেকে কাজ শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে যা পাই তা দিয়েই সংসার চলে। মজুরি বাবদ কেজি প্রতি মাছ বাছাই করে আট থেকে ১০ টাকা পাই। টাকা না নিলে চিংড়ির মাথা দেওয়া হয়। পরে সেসব চিংড়ির মাথা স্থানীয় বাজারে ১০-১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে সংসার খরচ চালাই।
মরিয়ম বেগম বলেন, তিন সন্তান থুইয়া মোর স্বামী তালাক দিছে। অনেক কষ্ট করে পোলাপান নিয়া থাহি। গরমে কাজ করতে পারলেও শীতের দিনে কাজ করতে অনেক কষ্ট হয়।
অপর নারী শ্রমিক আলেয়া বেগম বলেন, প্রতিদিন মাছ বাছাই করে হাতের চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। বাচ্চা লগে নিয়া কাজ করতে হয়।
আরেক শ্রমিক পুষ্প বালা বলেন, আমরা অনেকেই এখানে মাছ বাছাই করি। বেশি কাজ করলে বেশি মজুরি পাই। আমি দৈনিক আট থেকে ১০ কেজি মাছ বাছাই করি।
এ বিষয় নারী অধিকার ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘জাগো নারী’র পরিচালক ডিউক ইবনে আমিন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমনিতেই উপকূলের জীবন-জীবিকা থমকে গেছে। তাছাড়া পাথরঘাটা উপকূলে বিশেষ করে নারী ও শিশু ঝুঁকির মধ্যে থাকে। নারীর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তো আছেই। এ ক্ষেত্রে উপকূলের জীবন-জীবিকা নিয়ে সরকারকে নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এখনো নারী শ্রমিকরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, ঠিকমতো মজুরি পাচ্ছেন না। উপকূলের নারী শ্রমিকদের নিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সূত্র : বাংলানিউজ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।