জুমবাংলা ডেস্ক : ছোটবেলা থেকেই বাসের প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা ছিল আব্দুল আউয়াল শুভর। যখন ভালো ব্র্যান্ডের কোনো বাস পাশ দিয়ে যেত অপলক নয়নে দেখতেন আর চিন্তা করতেন একদিন চালক হবেন, এই বাসগুলো চালাবেন। কিন্তু বাস চালানোর সেই ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে না পারলেও কিছুদিন কাজ করার সুযোগ হয়েছে গাইড (সুপারভাইজার) হিসেবে। তবে পূরণ হয়েছে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন। অ্যাপিয়ার্ড সার্টিফিকেট দিয়ে আবেদন করে প্রথম বিসিএসেই শুভ পেয়েছেন শিক্ষা ক্যাডার।
আব্দুল আউয়াল শুভর বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। ছোটবেলা কেটেছে সৈকত শহর কক্সবাজারে। সেখান থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাসের পর চলে আসেন উল্লাপাড়ায়। সেখান থেকে জিপিএ-৫ নিয়ে এইচএসসির পর ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে।
শুভ বলেন, ‘আমি স্কুলে এভারেজ স্টুডেন্ট ছিলাম। এসএসসি পাসের পর আমার কক্সবাজার পলিটেকনিকে সিভিলে চান্স হয়। কিন্তু আমার মনে হলো জীবনে বড় কিছু হতে হবে। তাই বাসার বাইরে যেতে হবে। সেই সময়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমার পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটানোর সৌভাগ্য হয়নি।’
শুভর কাছে বিসিএস একটা স্বপ্নের নাম, আবেগের জায়গা, ভালোবাসার জায়গা। যেটার জন্য মানুষ জীবনের সবকিছু ছেড়ে দিয়ে লেগে থাকতে পারে। এই জবি শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি জীবনের প্রতিটা সময় এই সাফল্যের সন্ধানে ব্যয় করেছি। ফলে হারাতে হয়েছে অনেক সুন্দর মুহূর্ত।’
‘অনার্সের প্রথম বর্ষ থেকে আমি নিজেকে স্থির করি যে প্রথম বিসিএসে ক্যাডার হব। তাই বিভিন্ন বিসিএস আইকনের প্রস্তুতি, পরামর্শ ইত্যাদি দেখতাম ও নোট করে রাখতাম। পাশাপাশি প্রচুর গণিত ও ইংরেজির টিউশন করাতাম। আমি নিজেই টিউশন মিডিয়া চালু করি। এটা আমাকে আর্থিক সচ্ছলতা দিয়েছে, সঙ্গে গণিত শিখিয়েছে। তবে অনার্স শেষ বর্ষে থাকাকালীন চলমান প্রায় ১০টি টিউশন ছেড়ে দিই শুধু স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে।’
‘এরপর অনার্সের চতুর্থ বর্ষের শুরুতে বিসিএস কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে ইংরেজি, আন্তর্জাতিক, বাংলার (সাহিত্য, ব্যাকরণ) বেসিক ধারণা নিয়েছি। কোভিড শুরুর দিকে সব রুটিন করে পড়া শুরু করি ও প্রচুর মডেল টেস্ট দিতাম। অবশেষে প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাই। এরপর পুরো প্রস্তুতি নিয়ে লিখিত পরীক্ষায় বসি।’
লিখিতের প্রস্তুতির সময় শুভ খুব একা হয়ে যান। কারণ, গ্রুপ সদস্যরা কেউ প্রিলি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি। শেষ পর্যন্ত ‘একলা চলো রে’ নীতি অবলম্বন করেন তিনি। বলেন, ‘লাইব্রেরিতে সারা দিন সময় দেয়া শুরু করলাম আর কোচিংয়ে মডেল টেস্ট দিতাম। এরপর লিখিত পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হই।’
তিনি বলেন, ‘আমার বিসিএস জার্নিতে আমি অসংখ্যবার হতাশায় ভেঙে পড়েছি। আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। ব্যস্ততা দেখিয়ে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের ফোন রিসিভ করিনি, দেখা করিনি, দাওয়াতে অংশগ্রহণ করিনি।’
আর অনার্স শেষের পরই মাস্টার্স না করে ক্যাম্পাস ছেড়ে দেয়া জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করেন এই জবি শিক্ষার্থী। বলেন, ‘আমি অনার্সে থাকাবস্থায় অ্যাপিয়ার্ড সার্টিফিকেট (স্নাতক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত না হলেও অবতীর্ণ প্রার্থী হিসেবে আবেদনপত্র জমা দিতে পারেন) দিয়ে প্রিলি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মাস্টার্স না করার সিদ্ধান্ত নিই। তাই ক্যাম্পাস থেকে সব বন্ধু-বান্ধবকে বিদায় দিয়ে ফার্মগেটে চলে আসি। আমার সহপাঠীরা সবাই ছিল একদিকে আর আমি অন্যদিকে। আমার মনে হয় এটাই ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। কারণ, মজার বিষয় আমার বন্ধু-বান্ধবরা মাত্র মাস্টার্স পাস করেছে, আর আমি এখন বিসিএস ক্যাডার।’
৪৪তম বিসিএসে প্রিলিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই তার মাথায় চেপে বসে বাসের চালক হওয়ার সেই ভূত। যদিও তিনি জানতেন চালক হওয়া আর সম্ভব হবে না। কিন্তু চাইলে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করে তার সেই স্বপ্ন কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারবেন। যেই মনে আসা, সেই কাজ।
২০২২ সালের অক্টোবরে এই শখ পূরণের জন্য শুভ দেশ ট্রাভেলসে গাইড (সুপারভাইজার) পদে সাক্ষাৎকার দেন। সুযোগও পেয়ে যান। কিন্তু জামানতের ২০ হাজার টাকা জোগাড় করতে না পেরে সেবার আর যোগ দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘আবার সামনে লিখিত পরীক্ষাও ছিল। তাই আফসোস না রেখে আবারও পড়াশোনা শুরু করি। আর দেশ ট্রাভেলসের ম্যানেজার (ঢাকা) আমজাদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি, যাতে পরে সুযোগ দেয়া হয়।’
‘এরপর লিখিত পরীক্ষা শেষে ২০২৩ সালের জুনে আবারও দেশ ট্রাভেলসে যাই। আমি তখন ভাবলাম বিসিএস ক্যাডার হয়ে গেলে আর কোনোদিনও আমার এই শখ পূরণ হবে না। সারা জীবনই এটা নিয়ে আফসোস করতে হবে। আবার ৪৪তম বিসিএসের রিটেনও শেষ। তাই ২০ হাজার টাকা ১০ জনের কাছ থেকে ধার নিয়ে জমা দিয়ে দেশ ট্রাভেলসের এসি (হুন্দাই) গাইড (সুপারভাইজার) হওয়ার সুযোগ পেলাম। আমার ছোটবেলার শখ পূরণ হলো,’ যোগ করেন শুভ।
দেশ ট্রাভেলসের প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণ করে তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় ছয় মাস পার্টটাইম ডিউটি করেছি। অনেক ঘুরেছি, অনেক কিছু শিখেছি। গাইডের কাজ দেখতে সহজ মনে হলেও দায়িত্ব খুব সহজ না। বিলাসবহুল বাসের সব যাত্রী উচ্চবিত্ত। এখানে যাত্রীদের সাথে কথা বলা শিখতে হয়েছে; ম্যানজ করা শিখতে হয়েছে। আর ভাইভা বোর্ডে আমার যারা স্যার ছিলেন তারাও উচ্চবিত্ত শ্রেণির। তাদের চিন্তাভাবনার সাথে আমার বাসের যাত্রীদের চিন্তাভাবনা অনেকটা কাছাকাছি। শুনতে অবাক লাগলেও, গাইডের অভিজ্ঞতা আমার বিসিএস ভাইভায়ও কাজে লেগেছে।’ তাই শুভর পরামর্শ, জীবনের শখের জিনিসগুলো অপূরণ রাখতে নেই। সব পেশাই সমান, কোনো পেশাই ছোট নয়।
তবে এখানেই থেমে থাকতে চান না শুভ। তার লক্ষ্য পুলিশ ক্যাডার হওয়া। এ জন্য তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।