এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি.আর. আবরার বলেছেন, আমরা অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে সন্তুষ্টি নয়, বরং ন্যায্য নম্বর দিয়ে সততাকে বেছে নিয়েছি।
তিনি বলেন, আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলাম যেখানে সংখ্যাই সত্য হয়ে উঠেছিল।
পাশের হারই ছিল সাফল্যের প্রতীক, জিপিএর সংখ্যা ছিল তৃপ্তির মানদণ্ড। ফলাফল ভালো দেখাতে গিয়ে অজান্তেই শেখার প্রকৃত সংকট আড়াল করেছি। আজ আমি এবং আমরা এই মন্ত্রণালয় সেই সংস্কৃতির পরিবর্তন চাই।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় শিক্ষা সচিব রেহেনা পারভীনসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
গত বছরের তুলনায় পাসের হার ২০ শতাংশ কমেছে, এতে শিক্ষার্থীদের ওপর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে আমাদের করার কী ছিল? তাহলে কি আমরা নম্বর বাড়িয়ে দিতাম, যেমন অতীতে হয়ে এসেছে? মন্ত্রণালয় ও বোর্ড পরীক্ষা নিয়েছে, শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়েছে, শিক্ষকরা সময় নিয়ে খাতা মূল্যায়ন করেছেন। তারা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। শিক্ষার্থীরা যা প্রাপ্ত নম্বরের যোগ্য, শিক্ষকরা সেটিই দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান বিশ্বে জিপিএ-৫ নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। যিনি যোগ্যতা দিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছেন এবং যাকে নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে জিপিএ-৫ দেওয়া হয়েছে; এতে কি যোগ্য শিক্ষার্থীর প্রতি অন্যায় হচ্ছে না? বাস্তবতাটা কঠিন, এটা ঠিক, কিন্তু চলুন আমরা সকলে মেনে নিই।
উপদেষ্টা বলেন, আমরা অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে সন্তুষ্টি নয়, বরং ন্যায্য নম্বর দিয়ে সততাকে বেছে নিয়েছি। এই সিদ্ধান্ত সহজ নয়, কিন্তু প্রয়োজনীয়। কারণ আজ যদি আমরা সাহস করে বাস্তবতাকে স্বীকার না করি, তাহলে মেধাবী ও আগামী প্রজন্মের প্রতি অন্যায় করব। শিক্ষা মন্ত্রণালয় হিসেবে আমরা কোনোভাবেই এই ফলাফলের দায় এড়াতে পারি না। এই মন্ত্রণালয়ের কর্ণধার হিসেবে আমার প্রথম দায়িত্ব হলো নিজেকে এবং আমাদের পুরো ব্যবস্থাকে মূল্যায়নের আওতায় আনা। এই ফলাফলকে আমি আত্মসমালোচনার সুযোগ হিসেবে দেখছি। এখন এমন এক সময় এসেছে, যখন শিক্ষাবোর্ড, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একত্রে শেখার ভবিষ্যৎ নিয়ে সততার সঙ্গে কথা বলার সময় এসেছে।
তিনি আরও বলেন, ভালো ফলাফল মানে শুধু পরিসংখ্যান নয়, এটি পরিবার, আশা, পরিশ্রম এবং ভবিষ্যতের গল্প। প্রথমেই আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই যারা ভালো ফল করেছে তাদের। একই সঙ্গে যাদের ফল প্রত্যাশা মতো হয়নি, তাদের প্রতিও সহানুভূতি জানাই। আমি জানি, হতাশা আছে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এই মুহূর্তও শেখার অংশ। তোমাদের পরিশ্রম কখনোই বৃথা যাবে না।
তিনি বলেন, এ বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল অনেকেই বিস্মিত। পাসের হার ও জিপিএ-৫ কম। প্রশ্ন উঠেছে কেন? এর উত্তর জটিল নয়, বরং সহজ কিন্তু অস্বস্তিকর। শেখার সংকট বাংলাদেশে শুরু হয় খুব শুরুর দিক থেকেই। প্রাথমিক স্তর থেকেই ঘাটতি তৈরি হয় এবং সেই ঘাটতি বছরের পর বছর সঞ্চিত হয়। কিন্তু আমরা দীর্ঘদিন এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চাইনি।
সি.আর. আবরার বলেন, একজন দায়িত্বশীল উপদেষ্টা হিসেবে আমি চাই শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করুক। যে ফলাফল শিক্ষার্থীর শেখাকে সত্যিকারের মূল্যায়ন করে, সেটিই হোক আমাদের সাফল্যের মানদণ্ড। এসএসসি ফলাফল প্রকাশের পর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যে উদ্বেগ উঠেছিল, আমি তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছি। আমরা সকল শিক্ষা বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছি যেন ভবিষ্যতের পরীক্ষায়, বিশেষ করে এইচএসসি মূল্যায়নে সীমান্তরেখায় থাকা শিক্ষার্থীদের প্রতি সর্বোচ্চ ন্যায্যতা বজায় রাখা হয়— তবে ফলাফলের বাস্তবতা বিকৃত না হয়।
তিনি আরও বলেন, আমরা সমমূল্যায়ন ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডকে তাদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার একটি স্বতন্ত্র পর্যালোচনা প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি আমরা শিক্ষাবিদ, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করছি, যারা তথ্য বিশ্লেষণ করে শেখার মূল ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করবে।
উপদেষ্টা বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য অভিযোগ নয়, সমাধান। আগামী সপ্তাহে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি জাতীয় শিক্ষা পরামর্শ সভা আয়োজন করছে, যেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি খাতের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। আমরা সবাই মিলে প্রশ্ন করব—কী ভুল হচ্ছে, কেন হচ্ছে এবং কিভাবে বদলানো যায়। বোর্ডগুলোর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া যাচাই করার জন্য আমরা ‘র্যান্ডম স্যাম্পল অডিট’ শুরু করেছি। সীমান্তরেখায় থাকা পরীক্ষার খাতাগুলো বেছে নিয়ে স্বাধীনভাবে পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। উদ্দেশ্য শাস্তি নয়, শেখা—কিভাবে মান উন্নত করা যায় তা বোঝা। আমরা এডটেক প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গেও কাজ করছি।
তিনি বলেন, আমরা মার্কিং রুব্রিক ও মডারেশন প্রোটোকল পর্যালোচনা করছি, যেন ভবিষ্যতের পরীক্ষায় শিক্ষকরা আরও একীভূত মানদণ্ডে মূল্যায়ন করতে পারেন। এজন্য রিফ্রেশার প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালুর সম্ভাবনাও বিবেচনা করছি। শেখার মান যাচাই করতে আমরা আন্তর্জাতিক রেফারেন্স ফ্রেমওয়ার্কগুলোকেও বিবেচনা করছি।
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনে সরকার বদ্ধপরিকর : আইন উপদেষ্টা
শিক্ষকদের আন্দোলন যৌক্তিক বলে মনে করেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষকরা যে ধরনের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা পান, তার থেকে অনেক বেশি পাওয়া উচিত— এ বিষয়ে কোনো দ্বিধা নেই। এ বিষয়ে আমরা বারবার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।