সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ : দীর্ঘমেয়াদী নানামুখী সংকটের কারণে মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে মানিকগঞ্জের স্বাস্থ্যখাত। চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারী, পরিচ্ছন্নকর্মী ও ওষুধসহ নানা সংকটে ধুকছে জেলার সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা। বেসরকারি ক্লিনিকের দালাল চক্র ও ওষুধ কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টটেটিভদের দৌরাত্ম্যে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হয় সেবাগ্রহীতাদের।
গত কয়েকদিন মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বেশ কিছু বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে তদন্ত করে জুমবাংলা। তদন্তে বেরিয়ে আসে নানা অনিয়ম ও সংকটের চিত্র।
মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল:
হাসপাতালটি ২০১৭ সালে ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এর পর দীর্ঘ আট বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ২৫০ শয্যার জনবল কাঠামো পূরণ করা হয়নি। উল্টো ১০০ শয্যার জনবল দিয়ে হাসপাতালটি পরিচালনা করা হলেও সেখানেও জনবল সংকট রয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালটিতে গাইনী এন্ড অবস, কার্ডিওলজি, সার্জারি, মেডিসন ও অ্যানেসথেসিয়াসহ ১৩টি চিকিৎসকের পদ শূন্য। একই সাথে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সংকট থাকায় মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে হাসপাতালটির কার্যক্রম।
এছাড়া কর্তব্যরত চিকিৎসকদের অধিকাংশই নির্ধারিত সময়ে হাসপাতালে উপস্থিত হন না। ডিউটি শুরুর দেড় থেকে দুই ঘন্টা পর হাসপাতালে আসেন তারা। আবার ডিউটি টাইম শেষ হওয়ার আগেই ত্যাগ করেন হাসপাতাল। হাসপাতালে ওষুধের কোন সংকট নেই বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও অধিকাংশ সেবাগ্রহীতারা পর্যাপ্ত ওষুধ পান না বলে দাবি করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাইনী এন্ড অবস, সার্জারি, অর্থোপেডিক, আল্ট্রসনোগাফি, চক্ষু ও বক্ষব্যাধিসহ নানা বিভাগের চিকিৎসকেরা সপ্তাহে তিন থেকে চারদিনের বেশি অফিস করেন না। তবে নিয়মিত হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন তারা।
হাসপাতালাটির একাধিক কর্মচারীর সাথে কথা হলে তারা চিকিৎসকদের অনিয়মিত উপস্থিতির বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে তারা কেউ প্রকাশ্যে বা ক্যামেরায় বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
কথা হয় চিকিৎসা সেবা নিতে আসা একাধিক রোগীর সাথে। তারা চিকিৎসকদের দেরি করে উপস্থিত হওয়ার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চিকিৎসা নিতে আসলে আমাদের দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় চিকিৎসকরা আসেন না। একদিনের টিকিট দিয়ে আরেক দিন সেবা দেন না চিকিৎসকরা। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় সেবাগ্রহীতাদের।
জেলার ঘিওরের নয়ারচর গ্রাম থেকে আসা ষাটোর্ধ্ব ইয়াকুব দেওয়ান সকাল পৌনে দশটার দিকে জুমবাংলাকে বলেন, আমি এক ঘন্টা ধরে ডাক্তারের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। ডাক্তার কখন আসবে জানি না। আমার মতো আরো অনেকেই অপেক্ষা করছে।
সদর উপজেলার গুলটিয়া গ্রামের মো হাসান (৩৮) নামের এক যুবক বলেন, আমি দেড় ঘন্টা ধরে ডাক্তারের অপেক্ষায় আছি। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা ঠিক মতো আসেও না, জণগণের ভোগন্তিও কমে না। এদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।
সপ্তাহে তিনদিন অনুপস্থিত থাকা ও হাজিরা খাতায় নিয়মিত স্বাক্ষর করার কারণ জানতে চাইলে আল্ট্রসনোগাফি বিভাগের চিকিৎসক দেবারতী বসাক বলেন, আমি সাংবাদিক বা বাইরের কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। আমার যা কিছু বলার কর্তৃপক্ষকে বলবো।
আরেক চিকিৎসক মো. তালহা বলেন, আমি নয়টায় হাসপাতালে এসে অফিস রুমে ছিলাম। রোগী দেখা শুরু করেছি পৌনে দশটায়। অফিসের লোকজন আগে না আসলে তো আর আমরা কাজ শুরু করতে পারি না।
হাসাপতালটির আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ড. এ বি এম তৌহিদুজ্জামান সুমন বলেন, আমাদের এখানে চিকিৎসক সঙ্কট রয়েছে। যারা আছেন তাদের অধিকাংশ চিকিৎসক একাই কয়েকজনের কাজ করেন। ফলে তাদের একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। আর তাদের বেশি চাপ দিলে অন্যত্র বদলি হয়ে যান, তখন তো সেবা দেয়ার মত কেউই থাকবে না। তারপরও যতটুকু সম্ভব ভালোভাবে হাসপাতাল চালানোর চেষ্টা করি আমরা।
হাসাপতালটির তত্বাবধায়ক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন বলেন, আমাদের হাসপাতালে ওষুধ সংকট নেই। তবে জনবল সংকট থাকায় চিকিৎসা সেবা দিতে একটু হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর চিকিৎসকদের দেরি করে আসা এবং অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল :
২০২০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। মাত্র পাঁচ বছরে ভেঙ্গে পড়েছে ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট এই মেডিকেল কলেজের স্বাস্থ্যসেবা। চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারী, পরিচ্ছন্নকর্মী ও ওষুধসহ নানা সংকটের কারণে হাসপাতালটির অধিকাংশ বিভাগের সেবাই এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অকেঁজো অবস্থায় পড়ে আছে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। আলট্রাসনোগ্রাম, এক্স-রে, সিটি স্ক্যান ও এমআরআই পরীক্ষাসহ সব ধরনের পরীক্ষাই বন্ধ। এমনকি ডেন্টাল বিভাগের অধিকাংশ ডেন্টাল চেয়ার নষ্ট। কাঁচামাল সরবরাহ ও সংস্কার উদ্যোগ না নেওয়ায় ডেন্টাল বিভাগের সেবা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এছাড়া দক্ষ জনবলের অভাবে শুরু থেকেই তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে ৩০ শয্যার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)।
হাসপাতালটির রেডিওলজি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটিতে অত্যাধুনিক তিনটি ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন রয়েছে। যার দুইটি মেশিন বর্তমানে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। একটি মেশিন দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে অল্প কিছু রোগীকে এক্স-রে করা হয়। বাকি রোগীদের ভরসা বাইরের মানহীন বেসরকারি ক্লিনিক। এছাড়া যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ সিটি স্ক্যান মেশিন। প্রায় ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এমআরআই মেশিন ক্রয় করা হলেও এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি সেটি।
রেডিওলজি বিভাগের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জুমবাংলাকে বলেন, আমাদের অধিকাংশ মেশিন নষ্ট। এমআরআই মেশিন তো কখনো আলোর মুখ দেখেনি। তাছাড়া সিটি স্ক্যান মেশিনটিও ছয় মাস ধরে বন্ধ হয়ে আছে। তিনটি এক্স-রে মেশিনের মধ্যে দুইটাই নষ্ট।
জানা যায়, এই মেডিকেল কলেজে প্রথমে ১০ শয্যা বিশিষ্ট আইসিইউ বিভাগ খোলার পর পরবর্তীতে নতুন করে ২০ শয্যার আরেকটি আইসিইউ ইউনিট খোলা হয়। তবে এখন পর্যন্ত তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে এই ইউনিটটি। দক্ষ জনবলের অভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি এই বিভাগের কার্যক্রম।
সবচেয়ে বেশি অভিযোগ মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের বিরুদ্ধে। এখানেও বেশ কয়েটি মেশিনের টেকনিক্যাল সমস্যা রয়েছে। ফলে অধিকাংশ রোগীদের বাইরের বেসরকারি ক্লিনিকে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয়। হাসপাতালটির অনেক চিকিৎসক বাইরের ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার করানোর জন্য উৎসাহিত করেন রোগীদের।
হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ যেন একটি নিয়মিত ব্যাপার। বিগত কয়েক মাসে চিকিৎসক ও নার্সদের অবহেলায় বেশ কয়েকজন রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে এই মেডিকেল কলেজে। রোগীদের সাথে প্রতিনিয়ত খারাপ আচরণের অভিযোগ করেন স্বজনরা।
তবে এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কোন খোঁজখবর রাখেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালটির পরিচালক ডা. শফিকুল আলম বলেন, আপনি যেসব বিষয়ে বললেন সেগুলো আমার জানা নেই। আমি খোঁজখবর নিয়ে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবো।
বেসরকারি হাসপাতাল:
এদিকে জেলায় প্রায় সত্তরটি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে বলে জানায় সিভিল সার্জন অফিস। নিয়মিত নবায়ন করা হয়নি এসব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স। পর্যাপ্ত চিকিৎক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, টেনিশিয়ান ও মানসম্মত যন্ত্রপাতি না থাকার অভিযোগও রয়েছে অধিকাংশ ক্লিনিকের বিরুদ্ধে। অনুমোদিত আসন সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগী ভর্তি করে নামমাত্র চিকিৎসা সেবা দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন এসব ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ।
এসব বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত তদারকি করা হয় না বলে দাবি করেন স্থানীয় সচেতন নাগরিকেরা। ফলে, ভুল চিকিৎসা ও অপচিকিৎসার শিকার হয়ে প্রতিনিয়িত বাড়ছে রোগী মৃত্যুর মিছিল।
সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রাপ্ত বেসরকারি হাসপাতালের তালিকায় দেখা যায়, চলতি অর্থ বছরে জেলার একটি হাসপাতালও লাইসেন্স নবায়ন করেনি। গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে লাইসেন্স নবায়ন করেছে মাত্র ১৪টি ক্লিনিক। এছাড়া, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ১৪টি, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ১৬টি, ২০২১-২২ অর্থ বছরে ১১টি, ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৪টি, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৩টি ও ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে একটি হাসপাতাল সর্বশেষ নিজেদের লাইসেন্স নবায়ন করেছে।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. খুরশীদ আলম বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনি তালিকা করে দেন। আমি খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।