বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবজাতির জন্য যেভাবে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে, তেমনি তার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। অনেক দেশেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নীতিমালা পর্যন্ত করা হচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি দিন দিন আরো উন্নত হতে থাকে তাহলে তা মানবজাতির বহুমুখী বিপদের কারণ হতে পারে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরে সারা পৃথিবীতে প্রায় দেড় কোটি মানুষ তাদের চাকরি হারাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে কর্মসংস্থানের পরিধি সম্প্রসারিত হওয়ার পরিবর্তে যদি সংকুচিত হয়, সেক্ষেত্রে ব্যাপক সংখ্যক কর্মরত জনশক্তি কর্মহীন হবে। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর বেশি বিনিয়োগ করছে। এজন্য তারা প্রচুর পরিমাণ কর্মী ছাঁটাই করছে।
বিশ্ব বিখ্যাত আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের তাদের এক প্রতিবেদনে বলছে, আগামী বিশ্বে অন্তত ৩০ কোটি মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যন্ত্রের প্রভাবে চাকরি হারাবে। বিশ্বের অনেক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কয়েক বছরের মধ্যে চালকবিহীন গাড়ি চালানোর প্রযুক্তি পুরোদমে বাজারে ছাড়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যতই উন্নত হচ্ছে ততই নানা পেশা ও নানা কাজ যন্ত্র নির্ভর করে তোলার দৌড় বাড়ছে। এর মধ্যে জনপ্রিয় আর সফল হয়ে উঠেছে কণ্ঠস্বর হুবহু নকল করার প্রযুক্তি। এতে বিশেষজ্ঞরা খুবই উদ্বিগ্ন যে এই প্রযুক্তি সাইবার অপরাধের জন্য খুবই উর্বর একটা ক্ষেত্র। মানুষকে অপরাধীদের ফাঁদে ফেলা অপরাধীদের জন্য খুবই সহজ হবে। এ ধরনের কৃত্রিম কণ্ঠ ব্যবহারের ব্যাপক নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে।
গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই বলেছেন, ‘ব্ল্যাকবক্স’ নামে একটি ঘটনার কারণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এই ব্ল্যাকবক্স ঘটনাটিকে এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটি বিষয় চলে আসে। মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যখন নৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাবে তখনই বিপত্তি বাঁধবে। আর এখানেই অনেকের শঙ্কা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি চাহিদামত চিত্রকর্ম, সংগীত বা কোন বিষয়ে গল্প উপন্যাস মুহূর্তেই লিখে দিতে পারে তাহলে মানুষ সৃজনশীলতা চর্চা বাদ দেবে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লেখার দিকেও হাত বাড়িয়েছে চ্যাটজিপিটি। লেখকের কল্পনা প্রতিভা কিংবা লিপিকুশলতার আর প্রয়োজন হবে না।
শিল্প-সংস্কৃতির অন্যান্য দিকেও রয়েছে শঙ্কা। হলিউডে অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রবল শঙ্কা তৈরি করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। যে কোনো অভিনেতার মুখচ্ছবি কিনে নিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে চরিত্র নির্মাণ করছে। অর্থাৎ যে কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীর মুখের ছবি একবার ধারণ করার পর সেই অভিনয় শিল্পীকে আর প্রয়োজন হচ্ছে না।
এর আগে, হলিউডের চিত্রনাট্যকাররা ধর্মঘট ডেকেছিলেন একই কারণে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপ্রয়োগ হলে মানুষের গোপনীয়তা নিঃসন্দেহে হুমকির মুখে পড়বে। মানুষের ব্যাংক তথ্য, ঋণের তথ্য, ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড এর গোপন পিন নম্বর থেকে শুরু করে তার সমস্ত গোপনীয়তা মুহূর্তেই প্রকাশ হয়ে যেতে পারে, এমনকি তার বিভিন্ন আইডি পাসওয়ার্ড হ্যাক হয়ে যেতে পারে মুহূর্তেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে আসল ছবিতে নানারকম পরিবর্তন করা এবং অশ্লীল ছবি তৈরির সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গিয়েছে।
এ ব্যাপারে কথা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সোহরাব হোসাইনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এআই এর অনেক ব্যবহার, সবগুলোর নাম অনেকেই জানেন না। যেমন- রোবটিক্স এআই এর একটি ব্রান্ড। রোবট দিয়ে অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে এআই ব্যবহার করে। দেখা যায়, উন্নত দেশগুলোতে অটোমেটেড কার রয়েছে, যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয় এআই এর মাধ্যমে। এছাড়া অনেক দেশে মেট্রোরেল এআই এর মাধ্যমে চালানো হয়।
এতে কর্মসংস্থান কমবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এই প্রযুক্তির কারণে কিছু কিছু কর্মসংস্থান কমবে আবার কিছু টেকনিক্যাল দক্ষ লোকের কর্মসংস্থান বাড়বে। তবে যারা এডভান্স টেকনোলজিগুলো জানে তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে কোনো ধরনের শঙ্কা তৈরি হবে না। যেসব লোক চাকরি হারাবে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক লোক চাকরি পাবে। এক্ষেত্রে এক্সপার্টাইজ বাড়াতে হবে।
এআই প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক নিয়ে তিনি আরো বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ডিপফেক এর মাধ্যমে কোনো অডিও, ছবি কিংবা ভিডিওতে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে অন্য একজন ব্যক্তির মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত করা যায়। ফলে এই প্রযুক্তি জানা থাকলে যে কেউ সহজে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করতে পারে। অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
এছাড়া এআই প্রযুক্তি নিয়ে তিনি আরও বলেন, মেশিন লার্নিং এর মাধ্যমে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন সাইবার আক্রমণও করা যায়। ইতোপূর্বে এ ধরনের সাইবার আক্রমণ অনেক দেশে হয়েছে। এছাড়া চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যাসাইনমেন্ট বা এ ধরনের কাজ করিয়ে নিচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের চিন্তা, ক্ষমতা নষ্ট হবে এবং তাদের বার্ষিক দক্ষতা কমে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, এ আই প্রযুক্তির অনেক সুবিধা অসুবিধা রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বন্দুকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বন্দুক দিয়ে যেমন রক্ষা করা যায় ঠিক তেমনি মারাও যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও ঠিক তেমন। এটির ব্যবহারের ওপর নির্ভর করবে এর মাধ্যমে ভালো করা হবে নাকি খারাপ করা হবে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিকে দোষ না দিয়ে, প্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর ফোকাস করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এ আই প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে তাদের পড়াশুনা নিয়ে অনেক শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীরা প্রপার শিক্ষাটা নিচ্ছে না। তারা আসলে প্রযুক্তি নির্ভর। কোনোকিছু শিখছে না।ফলে ভবিষ্যতেও এটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে শিক্ষাক্ষেত্রে। তবে এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।