ধর্ম ডেস্ক : সন্তানের কাছে মাতা-পিতার যেমন সদাচরণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে, তেমনি তাঁদের অর্থনৈতিক অধিকারও রয়েছে। একসময় মাতা-পিতা বৃদ্ধ হয়ে যান। তাঁরা কর্ম করে খেতে পারেন না। তাঁদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়।
এমন করুণ পরিস্থিতিতে মাতা-পিতার দায়ভার নিতে হবে সন্তানকে। যে মাতা-পিতা অক্লান্ত পরিশ্রম করে সন্তান লালন-পালন করে বড় করে তুলেছেন তাঁদের এ বয়সে ভালো থাকার অধিকার আছে। সন্তান তার সামর্থ্য অনুপাতে মাতা-পিতার জন্য খরচ করবে। সন্তান মানুষের সবচেয়ে বড় উপার্জন।
সন্তানরা একটি বৃক্ষের ন্যায়, যাদের মাতা-পিতা সেবা-যত্ন করে বড় করে তোলেন। সন্তান একসময় উপার্জন করতে শেখে। বৃক্ষের ফলদানের সময় চলে আসে। এই ফল ভোগের সর্বাধিক অধিকার রাখেন মাতা-পিতা। তাই স্ত্রী-সন্তানের পাশাপাশি মাতা-পিতার প্রয়োজনে খরচ করতে হবে।
সন্তানের সম্পদ থেকে কী পরিমাণ ও কখন নিতে পারবেন
মাতা-পিতা তাঁদের নিজেদের প্রয়োজন অনুপাতে সন্তানের সম্পদ নিতে পারবেন। বিনা প্রয়োজনে বা মাতা-পিতা সম্পদশালী হলে সন্তানের সম্পদ থেকে দাবি করে বা বল প্রয়োগ করে কিছুই নিতে পারবেন না। হাদিসে এসেছে, কায়েস ইবনু আবি হাজেম বলেন, ‘আমি একদিন আবু বকর (রা.)-এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় একজন লোক এসে বলল, হে রাসুলের খলিফা! ইনি আমার সমুদয় সম্পদ ছিনিয়ে নিতে চান।
আবু বকর তখন তাঁর পিতাকে বললেন, তুমি কী বলো? সে বলল, হ্যাঁ। আবু বকর (রা.) তাকে বলেন, তোমার জন্য যতটুকু প্রয়োজন কেবল ততটুক তার সম্পদ থেকে গ্রহণ করার অধিকার রয়েছে। সে বলল, হে আল্লাহর রাসুলের খলিফা! রাসুল (সা.) কি বলেননি যে ‘তুমি ও তোমার সমুদয় সম্পদ তোমার পিতার?’ আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ যতটুকুতে খুশি হয়েছেন তুমি ততটুকুতে খুশি হও।’ (মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৮০৬; মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, হাদিস : ৬৭৭১)
মাতা-পিতা সন্তানের সমুদয় সম্পদ নিতে পারবেন না। হাদিসে এসেছে, আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের সন্তানরা তোমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে দান। তিনি যাকে খুশি তাকে কন্যাসন্তান দান করেন, যাকে খুশি তাকে পুত্রসন্তান দান করেন। তারা ও তাদের সম্পদ তোমাদের, যখন তোমরা সেগুলোর প্রয়োজন বোধ করবে।’
(মুসতাদরাক হাকেম, হাদিস : ৩১২৩; সিলসিলাহ সহিহাহ, হাদিস : ২৫৬৪)
রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার সম্পদের অধিক হকদার তার সন্তান, পিতা ও সব মানুষ থেকেও।’
(সুনানু সাঈদ ইবনু মানসুর, হাদিস : ২২৯৩; বায়হাকি, সুনানুল কুবরা, হাদিস : ১৫৫৩১)
তিনি আরো বলেন, ‘কোনো মুসলমানের সন্তুষ্টি ছাড়া তার সম্পদ গ্রহণ করা হালাল নয়।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ২০৭১৪; সহিহুল জামে, হাদিস : ৭৬৬২)
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রহ.) বলেন, ‘সচ্ছল সন্তানের ওপর আবশ্যক হলো তার পিতার জন্য খরচ করা, তার পিতার স্ত্রীর জন্য খরচ করা ও ছোট ভাইদের জন্য খরচ করা। সে যদি এমনটি না করে তাহলে সে পিতার অবাধ্য, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী এবং দুনিয়া ও পরকালে আল্লাহর শাস্তির জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হবে।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া ৩৪/১০১)
ওলামায়ে কিরাম মাতা-পিতা কর্তৃক সন্তানের সম্পদ গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু শর্তারোপ করেছেন। যেমন—১. মাতা-পিতা দরিদ্র হতে হবে, যাদের কোনো সম্পদ নেই এবং কোনো উপার্জনও নেই। ২. মাতা-পিতার প্রতি খরচ করার জন্য সন্তানের সামর্থ্য থাকতে হবে।
ইবনু কুদামা (রহ.) দুটি শর্ত উল্লেখ করে
বলেন : প্রথমত, সম্পদ নেওয়ার কারণে সন্তানের প্রতি যাতে জুলুম না হয়, এর কারণে সে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং পিতা এমন কিছু নেবেন না, যা সন্তানের প্রয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দ্বিতীয়ত, পিতা এক সন্তানের সম্পদ নিয়ে আরেক সন্তানকে দেবেন না। (আল-মুগনি ৬/৬২)
কোনো কোনো ইসলামিক স্কলার পিতা কর্তৃক সন্তানের সম্পদ গ্রহণের জন্য ছয়টি শর্ত আরোপ করেছেন। ১. পিতা এমন সম্পদ গ্রহণ করবেন, যাতে সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত না হয় বা যে সম্পদের সন্তানের প্রয়োজন নেই। ২. অন্য সন্তানকে না দেওয়া। ৩. তাদের যে কেউ মৃত্যু রোগে আক্রান্ত না হওয়া। ৪. সন্তান মুসলিম ও পিতা কাফির না হওয়া। ৫. সম্পদ মজুদ থাকা। ৬. মালিকানার উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা। (মুহাম্মাদ বিন ইবরাহিম আলে শায়খ, ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েল : ৯/২২১)
সন্তানের পরিত্যক্ত সম্পদে মাতা-পিতার অধিকার
মাতা-পিতার আগে সন্তান মারা গেলে সন্তানের পরিত্যক্ত সম্পদে মাতা-পিতা ভাগ পাবেন। পিতা তিন অবস্থায় সন্তানের সম্পত্তিতে অংশীদার হবেন। ১. সন্তানের ছেলে বা ছেলের ছেলে থাকলে পিতা সম্পদের এক-ষষ্ঠাংশ পাবেন। ২. সন্তানের স্ত্রী-সন্তান না থাকলে পিতা ওয়ারিশ ও আসাবা হিসাবে সন্তানের সমুদয় সম্পদ পাবেন। ৩. সন্তানের কেবল কন্যাসন্তান থাকলে পিতা ওয়ারিশ হিসাবে এক-ষষ্ঠাংশ ও আসাবা হিসাবে বাকি সম্পত্তি পাবেন। অন্যদিকে মাতাও তিনটি ক্ষেত্রে সন্তানের সম্পত্তিতে অংশীদার হবেন। ১. সন্তানের সন্তান থাকলে মাতা সম্পদের এক-ষষ্ঠাংশ পাবেন। ২. সন্তানের কোনো সন্তান ও ভাই-বোন না থাকলে মাতা সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ পাবেন। ৩. সন্তানের একাধিক ভাই-বোন থাকলে মাতা সম্পদের এক-ষষ্ঠাংশ পাবেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মৃতের মাতা-পিতার প্রত্যেকে পরিত্যক্ত সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ করে পাবে যদি মৃতের কোনো পুত্রসন্তান থাকে। আর যদি না থাকে এবং কেবল মাতা-পিতাই ওয়ারিশ হয়, তাহলে মা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। কিন্তু যদি মৃতের ভাইয়েরা থাকে, তাহলে মা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ মৃতের অসিয়ত পূরণ করার পর এবং তার ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রদের মধ্যে কে তোমাদের জন্য অধিক উপকারী, তা তোমরা জানো না। এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ১১)
মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।