নিজস্ব প্রতিবেদক: ভিসা সঠিক থাকা স্বত্ত্বেও ভিসা টেম্পারিংয়ের অভিযোগ এনে বাংলাদেশের অন্যতম সফল কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানাকে ‘অফলোড’ করেছিল কাতার এয়ারওয়েজ।
গত ৫ আগস্ট কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যায় সোহেল রানা। ভ্রমণ সংক্রান্ত সকল ডকুমেন্ট ইমিগ্রশনে সঠিক প্রমাণিত হওয়ার পরেও ভিসা টেম্পারিংয়ের অভিযোগ এনে শতশত যাত্রীর সামনে তাকে অপমান ও হেনস্থা করে কাতার এয়ারওয়েজ। এরপর তাকে ‘অফলোড’ করে চলে যায় ফ্লাইটটি।
সোহেল রানাকে ইস্যুকৃত ভিসা ‘জেনুইন’ বলে গতকাল (১৪ ডিসেম্বর) সুইডেন দূতাবাস নিশ্চিত করেছে। তাকে পাঠানো এক ইমেইল বার্তায় দূতাবাস জানায়, ‘The embassy has already confirmed to MOFA last week that the visa is genuine’।
নেদারল্যান্ডসে আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার মেলায় যাওয়ার জন্য এই ভিসা পেয়েছিলেন জাতীয় যুব পুরস্কারপ্রাপ্ত সোহেল রানা। এই মেলায় আম রপ্তানিকারক হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন তিনি। মেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জিও এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এলওআই দেয়া হয়। তিনি নিজেই ভিসার জন্য আবেদন করেন এবং সেনজেন ভিসা পান। নিজেই ভিসা সংগ্রহ করেন। সব ঠিক থাকা স্বত্ত্বেও কাতার এয়ারওয়েজ তাকে অফলোড করে।
সোহেল রানা জুমবাংলাকে জানান, ‘সরকারি আদেশ (জিও) অমান্য করে আমার সঙ্গে কাতার এয়ারওয়েজ যে ন্যাক্কারজনক আচরণ করেছে তার বিচার ও ক্ষতিপূরণ চেয়ে আমি কাতার এয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর সাতদিন সময় দিয়ে ইমেইল করেছি। মেইল রিসিভ করে কাতার এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষ অভিযোগের প্রেক্ষিতে একটি কেইস নাম্বার দিয়েছে। পাশাপাশি আমি কাতার এয়ারের ঢাকা ও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অফিসে চিঠি দিয়েছি। এছাড়া ভিসা ইস্যুকারি সুইডেন দূতাবাসকে ঘটনা বর্ণনা করে ভিসা যাচাইয়ের জন্য মেইল করেছিলাম। সুইডেন দূতাবাস এক মেইলের মাধ্যমে জানিয়েছে যে, আমার ভিসা জেনুইন এবং এটি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও তারা অবহিত করেছে।’
তিনি আরও বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকেও ঘটনা অবহিত করে চিঠি দিয়েছি।
সোহেল রানা জানান, ‘আমার নেদারল্যান্ডস ভ্রমণ সংক্রান্ত সকল ডকুমেন্ট ইমিগ্রশনে সঠিক প্রমাণিত হওয়ার পরেও কাতার এয়ারের মিথ্যা অভিযোগে বিমানে উঠবার আগে আমাকে অন্যায়ভাবে অফলোড করে। দূতাবাসের ইমেইল প্রমাণ করেছে কাতারের অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এই ঘটনায় কাতার এয়ারওয়েজ রাষ্ট্রের ও আমার সম্মানহানি করেছে। এছাড়া, আমার ব্যবসায়িক ক্ষতি করেছে, কৃষি সম্ভাবনা ও আম রপ্তানিকে গলা টিপে ধরেছে।’
তিনি বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সন্তোষজনক জবাব না পেলে আমি কাতার এয়ারওয়েজের বিরুদ্ধে যথাযথ আইন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেবো।’
কত টাকা ক্ষতিপূরণ দাবী করবেন এই প্রশ্নের উত্তরে সোহেল রানা জানান, ‘সম্মানহানি ও ব্যবসায়িক ক্ষতির জন্য কাতার এয়ারওয়েজের কাছে আমি ২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়েছি।’
গত ৬ আগস্ট এক ফেসবুক পোস্টে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে কাতার এয়ারওয়েজের ন্যাক্কারজনক আচরণের বিচার চান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সোহেল রানা।
ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, ‘আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স শেষ করে কৃষি কাজ করছি। ২০২১ সালে সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কতৃক জাতীয় যুব পুরস্কার লাভ করি। গত ২ বছর থেকে থেকে Global GAP মেনে আম উৎপাদন করে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনছি। বাংলাদেশের পক্ষে রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবেও আমার আম অনেক দেশে গেছে। আমার আম রপ্তানি নিয়ে দেশের প্রায় সব ইলেকট্রনিক, অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বহু প্রতিবেদন হয়েছে, আপনারা এগুলো দেখেছেন। এরই স্বীকৃতি হিসেবে নেদারল্যান্ডসে আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার মেলায় আমি আমন্ত্রিত ছিলাম।
নেদারল্যান্ডসের মেলায় বাগানের লেট ভ্যারাইটির কিছু আমের স্যাম্পল নিয়ে যাচ্ছিলাম বিদেশি বায়ারদের জন্য। আম রপ্তানি বাড়াতে অনেকের সঙ্গে বিজনেস মিটিং ছিল। আমাদের বাগানে এখনও এক মাস লেট ভ্যারাইটির আমগুলো থাকবে। নতুন নতুন জাত দিয়ে আম রপ্তানি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে, এই সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য এক্সপোতে যাওয়া আমার অন্যতম কারণ। আমি আগে কখনও বিদেশ যাইনি। এটি ছিল প্রথম বিদেশ যাত্রা।
আমি কাতার এয়ার ওয়েজে ৫ তারিখে ঢাকা-আমস্টারডাম টিকেট করি। ফ্লাইট ছিল ভোর ৪:২০টায়। ৪ তারিখ রাত ১১.৪৫ টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ১ নং টার্মিনালে প্রবেশ করি। এরপর বোর্ডিং পাস দেয়া শুরু হলে পাসপোর্ট, টিকেট, ভ্যাকসিন কার্ডসহ প্রয়োজনীয় কাগজ দেখিয়ে বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করি এবং ল্যাগেজ জমা দিয়ে ইমিগ্রেশনে যাই। ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট, বোর্ডিং পাস, জিও কপিসহ সব ডকুমেন্ট জমা দিয়ে ইমিগ্রেশন সম্পূর্ণ করি। এরপর বিমানে উঠবার জন্য ৫ নং গেটে অপেক্ষা করতে থাকি। নির্দিষ্ট সময়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেট পার হবার সময় কাতার এয়ার ওয়েজের দায়িত্বরত স্টাফ আমার পাসপোর্ট দেখে ভিসা জালিয়াতির অভিযোগ করে পাসপোর্ট, বোর্ডিং পাস রেখে দিয়ে পাশে দাঁড়াতে বলেন। আমি তাকে জিও কপি, এলওআই, রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্তির কথা বলি এবং আরও বলি আমি নিজ হাতে ভিসা পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছি, এখানে জালিয়াতির কোন সুযোগ নাই। এরপর তিনি শতশত যাত্রীর সামনে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন।
আমি দ্রুত ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে গিয়ে ঘটনা বলি। আমার ইমিগ্রেশন করা কর্মকর্তা এসআই জনাব দেলোয়ার আমাকে নিয়ে ৫ নং গেটে গিয়ে কাতার এয়ারের কর্মকর্তার কাছ থেকে আমার পাসপোর্ট ও আমার যাবতীয় ডকুমেন্ট সঙ্গে নিয়ে বিমানবন্দরের ভিসা বিশেষজ্ঞ টিমের মাধ্যমে পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভিসা সঠিক বলে মত দেয়। এরপর বিমান ছাড়ার আগে এসআই জনাব দেলোয়ার আমাকে সঙ্গে নিয়ে ৫ নং গেটে কাতার এয়ারের স্টাফের কাছে ভিসা সঠিক বলে জানান এবং আমার বিমানে যাত্রার জন্য আন্তরিকভাবে অনুরোধ করেন। এসআই দেলোয়ার কাতার এয়ারের কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রীয় জিও, এলওআই, জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্তি, গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা প্রতিবেদনসহ সব কিছু বলেন। এসব দেখে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কাতার এয়ার বিমান যাত্রা নাকচ করে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন ইনচার্জ বরাবর প্যাসেঞ্জার অফলোডের জন্য আবেদন করেন। এরই মধ্যে আমার ফ্লাইট ফ্লাই করে চলে যায়। ইমিগ্রেশন পুলিশ বহু চেষ্টা করে ব্যর্থ হবার পর কাতার এয়ারের আবেদনের প্রেক্ষিতে একটি জিডি করে আমার পাসপোর্টে ইমিগ্রেশন সিল বাতিল করেন।
কাতার এয়ারের কর্মকর্তরা আপত্তিকর ও অন্যায় অভিযোগ তুলে আমাকে বিমানে উঠতে দেননি। অথচ বোর্ডিং কার্ড এবং ইমিগ্রেশন ছাড়পত্র শেষে একজন আন্তর্জাতিক যাত্রীর সাথে এ ধরনের ঘৃণ্য আচরণ আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন।
ইমিগ্রেশন আইন, আমার রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার, মন্ত্রণালয়ের জিও, এলওআই, গণমাধ্যমের নানা প্রতিবেদন সব কিছুকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আমার সঙ্গে কাতার এয়ার ওয়েজের এমন জঘন্য, নিন্দনীয় কাজের জন্য আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাই। বিমানে উঠবার আগে যাত্রা বাতিল করে কাতার এয়ার ওয়েজ আমার মানসম্মান হানির পাশাপাশি বড় ধরণের আর্থিক ক্ষতি, ইউরোপের অনেক বায়ারদের সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত মিটিং বাতিল হয়েছে। যা আম রপ্তানি রিলেটেড ছিল। ভিসা জালিয়াতির অভিযোগ করায় এতে করে আমাদের রাষ্ট্রীয় সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে।’
সোহেল রানার বাড়ি নওগাঁর সাপাহার উপজেলায়। ২০১৫ সালে সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে দিয়ে সোহেল রানা নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার রূপগ্রামে গড়ে তোলেন ‘রূপগ্রাম এগ্রো ফার্ম’। এরপর সাপাহার উপজেলার গোডাউনপাড়ায় গড়ে তোলেন ‘বরেন্দ্র এগ্রো পার্ক’ নামে আরেকটি কৃষি খামার। বর্তমানে তাঁর মোট ১৫০ বিঘার খামারে রয়েছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের আম। আম ছাড়াও তার খামারে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির লিচু, পেয়ারা, ড্রাগন ফল, মাল্টাসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফলের গাছ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।