আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বেশ কয়েক বছর স্তিমিত থাকলেও সম্প্রতি নতুন করে ব্যাপক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে সোমালি জলদস্যুদের। মঙ্গলবার এই জলদস্যুরা বাংলাদেশি একটি জাহাজ ছিনতাই করে ২৩ জন নাবিককে জিম্মি করেছে। খবর বিবিসি’র।
লোহিত সাগরে হুথিদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলো বেশি ব্যস্ত থাকার সুযোগে ভারত মহাসাগরের গালফ অফ এডেনে তারা আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
উত্থানের নেপথ্যে
ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে ১৯৬০ সালে সোমালিয়ার জন্ম। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের উৎখাতের পরে নৈরাজ্যের মধ্যে পড়ে দেশটি। পরের দুই দশকের বেশি সময় যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমলিয়াতে কার্যকর কোনো সরকার ছিল না।
এই সময়টাতে আফ্রিকার মধ্যে দীর্ঘতম উপকূল সমৃদ্ধ দেশটির জলসীমার নিরাপত্তায় কোনো কোস্টগার্ড বা বাহিনী ছিল না।
এতে এই অঞ্চলে বিদেশি মাছ ধরা নৌযানের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। এতে স্থানীয় জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। ফলে তারা দস্যুবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইন্ডিয়ান ওশান কমিশনের সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতেও ওই সময়ের দস্যুতার নেপথ্যে এই কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। তাছাড়া, মৎস শিকারের চেয়ে দস্যুতায় আয়ের পরিমাণও অনেকগুণ বেশি।
তবে, কয়েক বছর তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ওই রুটে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়।
এর ফলে ২০১২ সাল নাগাদ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে দস্যুবৃত্তি।
ইউরোপিয়ান নৌবাহিনীর অপারেশন কমান্ডার রিয়ার অ্যাডমিরাল ডানকান পটস তখন বিবিসিকে বলেছিলেন, সামুদ্রিক দস্যুতার ‘বিজনেস মডেল’ কার্যকরভাবে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
দস্যুদের উদ্দেশ্য কী? আয় কেমন?
ত্রিকোণাকৃতির ভৌগোলিক মানচিত্রের কারণে পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলকে হর্ন অফ আফ্রিকা বলা হয়।
২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়কালে হর্ন অফ আফ্রিকার দস্যুরা কী পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে তার একটি আনুমানিক হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক।
সেই হিসাব অনুযায়ী জলদস্যুরা ক্রুদের জিম্মি করে সাড়ে তিনশো থেকে সোয়া চারশো মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আদায় করেছে।
এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে নাইজেরিয়ার ফেডারেল ইউনিভার্সিটির লেকচারার স্যামুয়েল ওয়েওল বলেন, ছিনতাইয়ের পেছনে মূল লক্ষ্য মুক্তিপণ আদায় বলেই ধারণা করা যায়। অন্ততঃ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর নেপথ্য এটিই মূল কারণ।
২০১১ সালে একটি তেলের ট্যাংকার জব্দ করে দস্যুরা। দুশো মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের জ্বালানি ছিল নৌযানটিতে। আটক দুই ফিলিপিনো ক্রুকে হত্যা করা হয়।
স্যামুয়েল ওয়েওল পূর্ব আফ্রিকান জলদস্যুতার ওপরে একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বহুজাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতায় দস্যুদের প্রতিহত করা সম্ভব হয়। সুতরাং, ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্য পুরোপুরিভাবে জানা যায় না সবসময়।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংস্থা ওশেন বিয়ন্ড পাইরেসির প্রতিবেদন বলছে, সাগরে দস্যুতার কারণে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে সাত থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার।
সোমালি দস্যুতার পুনরুত্থান?
আইওসি বলছে, সাম্প্রতিক হামলাগুলোর অন্তত ছয়টি জলদস্যুতা। বিবিসি পক্ষ থেকে আইএমবি’র কাছে জানতে চাওয়া হয়, গত কয়েক মাসের হামলাগুলোকে কী হিসেবে দেখা হচ্ছে?
আইএমবি জানায়, ‘বাণিজ্যিক জাহাজে হামলাগুলোকেই শুধু জলদস্যুতা হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।’
ইউরোপিয়ান নৌবাহিনী এমভি রুয়েনের ইস্যুটিকে একটা টেস্টকেস হিসেবে দেখছে। তারা বলছে, এই জাহাজটির ভবিষ্যত থেকেই ইঙ্গিত মিলবে ওই অঞ্চলে দস্যুতার ‘পুনরুত্থান’ দেখা যাবে কিনা। যদি এখান থেকে ভালো অর্থ আদায় করতে পারে, মৌসুম জুড়ে নৌ-ডাকাতি একটা লাভজনক পেশা হিসেবে আকৃষ্ট করতে পারে তাদের।”
মার্চে বাংলাদেশি মালিকানাধীন জাহাজে আক্রমণ ক্রমবর্ধমান দস্যুবৃত্তিরই ইঙ্গিত দেয়।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ চেস্টারের হর্ন অফ আফ্রিকার মেরিটাইম সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ জেস সিমন্ডস বলেন, ছিনতাইগুলোকে অবশ্যই কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে সামলানো উচিত।
তিনি জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত একটি সংজ্ঞার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
যেই সংজ্ঞা অনুসারে, জলদস্যুতা গভীর সমুদ্রে হয়, অর্থাৎ যে জলসীমা কোনও দেশের এখতিয়ারের বাইরে। ইইউন্যাভ ফর আটালান্টার তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক ছিনতাইয়ের অর্ধেক সোমালিয়ার আঞ্চলিক জলসীমায় ঘটেছে।
জেস সিমন্ডস বলেন, এর অন্য বিপদও আছে। সোমালিয়া থেকে দূরে হওয়ার কারণে যে কোনো আক্রমণই, জলদস্যুতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
দস্যুদের সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না কেন
জাহাজের মালিকদের লুকআউট বা দ্রুতগতিতে ভ্রমণের মতো পরামর্শ দিয়ে থাকে আইএমবি। যাতে জলদস্যুরা তাদের ধরতে না পারে। কিন্তু, জলদস্যুরাও ঝটিকা আক্রমণ চালায়। প্রায়শই রাতের অন্ধকারে হাজির হয় তারা। তাই, ক্রুরা ঘটনা বুঝে উঠতেই দেরি হয়ে যায়।
একবার জলদস্যুরা কোনো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে, সামরিক পদক্ষেপ নেয়া কঠিন হয়। কারণ, তাতে জিম্মিদের হতাহত হওয়ার শংকা বাড়ে।
গভীর সমুদ্রে আটক জলদস্যুদের বিচারের মুখোমুখি করতে জটিলতার কারণে কখনো কখনো ছেড়েও দেওয়া হতো।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি রেজুলেশন আছে যাতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত দেশগুলোকে সোমালি জলসীমায় দস্যুদের ধরার অনুমতির কথা বলা আছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।